৬১ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী পাঁচ শতাংশ রাজনীতিক: টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
সংসদীয় কার্যক্রমে আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আইন প্রণয়নের আলোচনায় সংসদ সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, অনাগ্রহ ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ: একাদশ জাতীয় সংসদ-প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৯)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদের ৬১ শতাংশ সাংসদ ব্যবসায়ী। বাকি ৩৯ শতাংশ সংসদ সদস্যের মধ্যে আইনজীবী ১৩ শতাংশ, রাজনীতিক পাঁচ শতাংশ ও অন্যান্য (শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিণী ও পরামর্শক ইত্যাদি) পেশার ২১ শতাংশ সদস্য রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের শতকরা ৫৯ শতাংশ এবং জাতীয় পার্টির শতকরা ৫৬ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। অন্যদিকে ভারতের ১৭তম লোকসভায় সংসদ সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিক ৩৯%, ব্যবসায়ী, ২৩%, আইনজীবী ৪% এবং অন্যান্য পেশার সদস্য রয়েছেন ৩৮%। টিআইবি বিগত কয়েকটি সংসদের সদস্যদের প্রধান পেশা বিশ্লেষণ করে বলছে, প্রথম সংসদে আইনজীবীদের শতকরা হার ৩১ শতাংশ ছিল, যা ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে একাদশ সংসদে ১৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের শতকরা হার প্রথম সংসদে ১৮ শতাংশ ছিল, যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে একাদশ সংসদে ৬১ শতাংশে পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনে সংসদ সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর/তদুর্ধ্ব প্রায় ৭৭ শতাংশ। এইচএসসি সমমানের প্রায় ১২ শতাংশ, এসএসসি বা তার কম শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন ১১ শতাংশ সংসদ সদস্য রয়েছেন। সরাসরি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে পুরুষ ৯২ শতাংশ ও নারী ৮ শতাংশ এবং সংরক্ষিত আসন সংখ্যা যথাক্রমে ৭৯ শতাংশ ও ২১ শতাংশ। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের একাংশ তাদের হলফনামায় সঠিক তথ্য (আয়ের উৎস, সম্পদের পরিমাণ, নির্বাচনী ব্যয় ও ব্যয়ের উৎস ইত্যাদি) প্রদান করেননি। নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ২১ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ৯ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। ভারতের ১৭তম লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশে উত্থাপনসহ প্রতিটি বিল পাস করতে গড়ে প্রায় ৩২ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে। অপরদিকে ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায় প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লাগে গড়ে ১৮৬ মিনিট।
টিআইবি বলছে, অধিকাংশ সংসদীয় কমিটিতে বিলের ওপর আলোচনায় ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। বিলের ওপর সংশোধনী এবং যাচাই-বাছাই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য বিরোধী সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়েছে। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল ৬৭ শতাংশ, অন্যান্য বিরোধী সদস্য ১৭ শতাংশ, সরকারি দল ১৬ শতাংশ (বিল উত্থাপনকারী মন্ত্রীরা) সময় ব্যয় করেছেন।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের পর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, ‘অষ্টম ও নবম সংসদে সমস্যার মূল যে জায়গা ‘সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি’ অগ্রহণযোগ্য ছিল। সেটি বন্ধ হয়েছে চড়া দামে। এত বেশি চড়া দামে যে, মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনের সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা রদবদলের সম্ভানা দূরীভূত হয়েছে। তারই প্রভাব আমরা দেখতে পারছি জাতীয় সংসদের মধ্যে। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ সংসদে একদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে একচ্ছত্র ক্ষমতার সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। সংসদের মৌলিক দায়িত্ব আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহিতা এবং জনপ্রতিনিধিত্ব— এই তিনটি ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা আমরা দেখতে পারছি না।
এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিরোধী দল থাকলে সংসদ বর্জন করে, সেই সংস্কৃতি আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। বর্জন বন্ধ হয়েছে। কারণ, কার্যকর বিরোধী দল বলতে যা বুঝায়, সেটি আমাদের কাছে নেই। এবারে সংসদে যাদের প্রধান বিরোধী দল বলা হয়েছে বা উপস্থাপন করা হয়েছে, তারা কিন্তু বিরোধী দলে বসবেন— সেই প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচন করেন নাই। তারা ক্ষমতাসীন জোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের বসানো হয়েছে বা বসেছেন এমন একটি ভূমিকায়, যেটার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। বাস্তবে প্রধান বিরোধী দল বলতে যা বুঝায় সেটি কিন্তু অনুপস্থিত।
২০১৯ সালের পাঁচটি অধিবেশনে মোট ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট কোরাম সংকট ছিল বলে জানিয়েছে টিআইবি। যা ৫টি অধিবেশনের প্রকৃত মোট ব্যয়িত সময়ের ১৭.৩ শতাংশ। পাঁচটি অধিবেশনে প্রতি কার্যদিবসে গড় কোরাম সংকট ছিল ১৯ মিনিট। প্রথম হতে পঞ্চম অধিবেশন পর্যন্ত কোরাম সংকটে ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য ২২ কোটি ২৮ লক্ষ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।
সংসদকে ‘কার্যকর’ করতে টিআইবি বেশকিছু সুপারিশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাস্তবিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে, .সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে, যেখানে স্বীয় দলের বিরুদ্ধে অনাস্থার ভোট এবং বাজেট ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে সদস্যদের নিজ বিবেচনা অনুযায়ী ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে, সংসদ সদস্যদের জন্য আচরণ আইন প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সংসদ সদস্যদের সংসদের ভেতরে এবং বাইরের আচরণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসারে নির্দেশনা থাকবে এবং সংসদীয় কার্যক্রম এমন হবে যেখানে সরকারি দলের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *