সংসদ প্রতিবেদক:
জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সংসদে সব সময়ই সোচ্চার রয়েছেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। বিশেষ করে সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশিদ ও ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানা জোরালো ভূমিকা রাখছেন। সদ্য সমাপ্ত হওয়া অধিবেশনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশে বন্দুক যুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির এই দুই সংসদ সদস্য। তারা ওই সকল হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অর্ডারে সিনহা হত্যাকান্ডসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তির পরিবার যাতে সুবিচার পায় সে জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা। বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা মো. হারুনুর রশিদ তার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এসব হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সংবিধান লংঘন করা হচ্ছে। পরে আলোচনায় অংশ নিয়ে একই দলের সদস্য ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানাও সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘনের অভিযোগ করেন।
আলোচনায় হারুনুর রশীদ বলেন, গত বছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এমপি হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র দুই দিন পর ৩০ এপ্রিল আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রকাশ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয়। একটি পেশাদারী প্রতিষ্ঠান বিকেলে ৪টায় একজন সাধারণ নাগরিককে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পুলিশি এজাহারে ওই ঘটনা থানা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ঘটেছে বলে দেখানো হয়। এজাহারে বলা হয়, পুলিশের উপর বেপরোয়া আক্রমণ চালানো হয়েছে। কিন্তু অস্ত্র দেখানো হয়েছে হাতে তৈরি অস্ত্র। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওই ঘটনায় দুইজন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। তাদের একজন আমাদের এলাকায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। আর তার বড় ভাই। অথচ ঘটনার দিন তারা সংসদে এসে সংসদ গ্যালারি থেকে আমাদের অধিবেশন দেখেছেন। সংসদে ঢুকতে হলে সবার অনুমতি নিতে হয়। এই সংসদের কাছে এ ধরনের ডকুমেন্টস আছে। তাদের নামে আমি পাস ইস্যু করেছিলাম।
হারুনুর রশীদ বলেন, এই ধরনের পুলিশ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তা নিয়ে নাটক বানাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের এলাকার এক ছাত্রকে ঢাকার শেওড়াপাড়া থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে এলাকায় ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। ঢাকা থেকে তুলে নেওয়ার চারদিন পর তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়। তিনি আরো বলেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের আজ বিচার হচ্ছে। আদালত তাদের পরিবারের মামলা গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে আরও প্রায় তিন হাজারের অধিক ব্যক্তি এমন হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। তারা কি বিচার পাবে না? তাদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে না? তাদেরকে কি রাষ্ট্র এই অধিকার দিবে না?
এরপর ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানা সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লংঘনের অভিযোগ করে বলেন, এই সরকার ২০১৩ সালে একটি আইন করেছিল ‘হেফাজতে নির্যাতন মৃত্যু নিবারণ আইন’। ওই আইনে চমৎকার সব ধারা থাকা সত্ত্বেও সেই আইনে খুব বেশি মামলা হয়নি। অথচ এই সাত বছরে অসংখ্য মানুষ পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে। কিন্তু তার মামলাগুলো কি হলো, কেন পরিবারগুলো মামলা করার সাহস পায় না, হলে কয়টি মামলা হয়, সেইসব মামলার কি অবস্থা, তার কিছুই আমরা জানি না। তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সকলেরই দৃষ্টি কেড়েছে। অথচ প্রতিদিনই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয়। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে ৪৬৬ জন, ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন এবং ২০২০ সালে করোনাকালে প্রথম ছয় মাসে ১৫৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন একজনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রচার করা হলেও এগুলোর একটিও কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারণ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত এক যুগে অর্থাৎ ১২ বছরে তিন হাজারের বেশী মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছেন। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বাংলাদেশ গুম বলে কোন শব্দ নাই। একই লাইন ধরে পুলিশের আইজি কিছুদিন আগে বলেছেন ক্রসফায়ার বলে কিছু নাই। এটি এনজিওগুলোর শব্দ। যে রাষ্ট্রে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হয়, সেখানে বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন থাকে না বলে তিনি দাবি করেন।
এদিকে নিজ নির্বাচনী এলাকায় ভূমিদস্যুদের করা মামলায় নাজেহাল বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদ। ৯ সেপ্টেম্বর বুধবার সংসদ অধিবেশনে এ বিষয়ে কার্যপ্রণালী বিধির ২৭৪ এর ব্যক্তিগত কৈফিয়ত চেয়ে বক্তব্য প্রদানকালে এমন অভিযোগ করেন তিনি। তিনি সংসদকে জানিয়েছেন, সরকার প্রধান চাইলে পদত্যাগ করবেন। এ সময় স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে হারুনুর রশীদ বলেন, আপনি আমাদের সংসদের অভিভাবক, আমরা এখানে ৩৫০ জন সংসদ সদস্য আছি। ৩৫০ জনের মধ্যে ৩৪২ জনই হচ্ছে মহাজোটের শরীক। আমার বিষয়টি আপনাকে দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমাকে কেন হয়রানি করা হবে? আমি কেন প্রতিকার চেয়েও পাবো না? তিনি আরো বলেন, একটি মামলা ১৮ মাস ধরে ঝুঁলিয়ে রাখা হয়েছে। যে তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটি ঝুলিয়ে রেখেছে, তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
গাড়ীর শুল্ক নিয়ে মামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপি’র সংসদীয় দলের নেতা হারুন বলেন, আমাকে ৫ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। সাথে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা। আপিল বিভাগে আপিল করার পর স্থগিত ছিল। আবার কে যেন রিট পিটিশন করেছে। কেন আমাকে এভাবে বিব্রত করা হচ্ছে। মিডিয়ায় বলছে এই মাসেই সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। আমাকে কোর্ট থেকে কিছু করতে হবে না। সংসদ নেতা বলে দিন, আমি পদত্যাগ করে চলে যাব। হারুনুর রশীদ বলেন, আমি এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল স্পিকারের কাছে একটি আবেদন দিয়েছি। গত বছর ৪ এপ্রিল আমার এলাকায় আমাকেসহ আমার বড় বোন ও ভগ্নিপতিকে আসামী করে জালিয়াতির একটি মামলা করা হয়। গত বছর এপ্রিল মাসে করা মামলা দীর্ঘদিন যাবৎ ওই ভাবেই পড়ে থাকে। তিনি আরো বলেন, আমি আমার জেলার আইন-শৃঙ্খলা কমিটির উপদেষ্টা। আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি পুলিশ সুপারকে বার বার অনুরোধ করেছি। অথচ আজ ১৮ মাস হয়ে গেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমার সন্তানরা বলে তুমি সিটিং এমপি, তোমার নামে ভূমি দস্যুরা মামলা করে, তুমি প্রতিকার পাওনা তুমি কেন যাও সংসদে, চলো বিদেশে চলে যাই। তিনি আরো বলেন, আমি যে বিষয়ের সাথে জড়িত নই, কেন আমাকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে? আমি বারবার তাগাদা দিচ্ছি, আমি কোনো ফেবার চাই না। আমি অভিযুক্ত হলে অভিযোগ দিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দেন আদালতে বিচার হোক।