সিন্ডিকেট মুক্ত করে অবশেষে কার্যকর মশার ওষুধের সন্ধান পেয়েছে ডিএসসিসি

রফিকুল ইসলাম সবুজ:
শেষে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে মশা মারার ওষুধ সংকট কাটিয়ে উঠছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। চাহিদার তুলনায় যৎসামান্য মজুত নিয়েই কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিল প্রতিষ্ঠানটি। চাহিদা অনুযায়ী ভাল ওষুধ না পাওয়াসহ নানা জটিলতায় গত ৯ মাস ধরে ওষুধ ফর্মুলেশনের দরপত্র চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। তাই তিন দফা শেষে চতুর্থ দফায় পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে হয়। তবে নতুন মেয়রের কঠোর পদক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ওষুধ ফর্মুলেশনের দরপত্র চূড়ান্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরি ওষুধের সন্ধান পেয়েছে বলে দাবি করেছেন ডিএসসিসি কর্মকর্তারা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বলছে, ডিএসসিসির ১৬টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর ঝুঁঁকিতে রয়েছে। গত বছর ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের পর হাইকোর্টের নির্দেশে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠিত হয় এবং এই কমিটি সরবরাহকারি সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়াসহ মশা মারার কার্যকরি কিটনাশক আমদানী ও ভাল প্রতিষ্ঠান থেকে ফরমুলেশন ক্রয়ের পরামর্শ দেয়। তখন বিদেশ থেকে সরাসরি ওষুধ আমদানি করার অনুমতি দেওয়া হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। এরপর বিদেশ থেকে ম্যালাথিউন ৫ শতাংশ আমদানি করে ডিএসসিসি। কিন্তু আমদানিকৃত ওষুধটি সরাসরি ব্যবহার উপযোগী নয়। এর সঙ্গে ৯৫ শতাংশ ডিজেল ও ২৫ থেকে ৫০ এমএল সাইট্রোনেলা মিশ্রিত করে ছিটাতে হয়। এজন্য ডিজেল এবং ওষুধের ফর্মুলেশন (মিশ্রণ) সঠিক হতে হয়। আর এই কাজটি করার জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনও প্রযুক্তি নেই। এজন্য দ্বিতীয় পক্ষ দিয়ে কাজ করতে হয় নগর ভবনকে।

ওষুধ ফর্মুলেশন করতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ৬ লাখ ৪০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইডিং ওষুধের জন্য দরপত্র আহ্বান করে ডিএসসিসি। তাতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি লিটার ওষুধের ফর্মুলেশন করতে দর দেয় ১৭২ টাকা। কিন্তু গত বছর মানহীন ওষুধ সরবরাহের অভিযোগ থাকায় প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ না দিয়ে ফের দরপত্র আহ্বান করে ডিএসসিসি। পুনঃদরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি সর্বনিম্ন দর দেয় ১৫৫ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মেসার্স দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস দর দিয়েছে ১৬৩ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা মেসার্স নোকন লিমিটেড দর দেয় ১৮৩ টাকা। কিন্তু দরপত্রের চাহিদা পুরন না হওয়ায় এই দফায়ও কাউকে কার্যাদেশ না দিয়ে তৃতীয় দফায় পরপত্র আহবান করা হয়। তবে তৃতীয় দফায়ও কাউকে কার্যাদেশ দেওয়া যায়নি।

ডিএসসিসির ভান্ডার বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চতুর্থ দফায় চাওয়া হয়েছিল ৫ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা। চতুর্থ দফার দরপত্রের পর গত ১১ অক্টোবর ম্যালাথিউন ৫ শতাংশ এর টেস্ট সম্পন্ন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলো। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের আইসিসিডিআর এর পরীক্ষায় এসিআই ফরমুলেশন এর কিটনাশকে কার্যকরি উপাদানের মাত্রা সঠিক ও সন্তোষজনক এবং উড়ন্ত মশা মৃত্যুর হার ১০০ শতাংশ বলে প্রমান পায়। ডিএসসিসি কর্মকর্তারা জানান, সরবরাহকৃত নতুন কিটনাশক ঢাকাবাসীকে মশকের উপদ্রব থেকে স্বস্তিতে রাখবে বলে তারা আশাবাদী। তবে গত এক যুগ ধরে মশার কিটনাশক সরবরাহকারি সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় থাকায় তারা সরবরাহকারি কিটনাশকের মান ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য তৎপর। তবে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপসের কঠোর পদক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে পেরেছে ডিএসসিসি। তারা বলছেন গত এক যুগ ধরে মশার কিটনাশক সরবরাহকারি সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় তারাই নিয়ন্ত্রন করতো সব কিছু। তবে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস দায়িত্ব নেয়ার পর তার কঠোর পদক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে পেরেছে ডিএসসিসি। নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর মশা নিধনে কীটনাশক সংগ্রহে আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর জোর দেওয়া শুরু হয়। এর আওতায় সম্প্রতি টেন্ডারের মাধ্যমে যাছাই-বাছাইকালেই বাদ পড়ে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা সিন্ডিকেটচক্রের প্রতিষ্ঠান। আর সিন্ডিকেটের কারনে এতো দিন দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কিটনাশক সরবরাহ থেকে দুরে ছিল। তবে নতুন মেয়রের পদক্ষেপের পর ভাল প্রতিষ্ঠান গুলো কিটনাশক সরবরাহে আগ্রহী হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, ডিপিএম পদ্ধতিতে (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) মেসার্স মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড থেকে প্রতি লিটার ১৭৮ টাকার বিনিময়ে ২৫ হাজার লিটার ও মেসার্স ফরওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল (বিডি) লিমিটেড থেকে ১৫০ টাকা করে তিন দফায় ৬৪ হাজার লিটার ওষুধ ফর্মুলেশন করে নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরে ফর্মুলেশন করা ৮৯ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইডিং ওষুধ সংগ্রহ করেছে ডিএসসিসি। ডিএসসিসির সংস্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মশার ওষুধ সংকটে পড়লে দরপত্র আহ্বান না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও ধরনের চুক্তি ছাড়াই গত বছরের শেষের দিকে এক লাখ ৬০ হাজার লিটার ওষুধ নেওয়া হয়। এর মধ্যে মেসার্স মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড থেকে এক লাখ লিটার ও দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড থেকে ৬০ হাজার লিটার ওষুধ নেয় ডিএসসিসি। কিন্তু এসব ওষুধের টাকা এখনও দিতে পারেনি সংস্থাটি। সংস্লিষ্টরা জানান, ওষুধ সংগ্রহের বৈধ কোনও কাগজপত্র না থাকায় তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সেই বিল পরিশোধ করে যাননি।

ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নগরবাসীকে মশার প্রকোপ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মশক নিধনে নতুন কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৭ জুন থেকে কাজ শুরু করা হয়েছে। ওষুধ প্রয়োগের সময় বাড়ানো, মান নিশ্চিত করা এবং সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করায় এরই মধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছে নগরবাসী।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সময়ের আলো।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *