রফিকুল ইসলাম সবুজ:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিশেষ অধিবেশনে বসতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদ। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় সংসদের দুটি বিশেষ বৈঠক বসলেও এটাই হবে প্রথম বিশেষ অধিবেশন; সেখানে সংসদ কক্ষে থাকবে জাতির জনকের প্রতিকৃতি। আগামী ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় বসবে সংসদের বৈঠক। এই বিশেষ অধিবেশনে বিএনপিসহ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারি সব দলই আলোচনার সুযোগ পাবে বলে সংসদ সচিবালয় সুত্র জানিয়েছে। সংসদ সচিবালয় সুত্র জানায়, আগামী ৮ নভেম্বর সংসদ শুরু হলেও ওইদিন বিশেষ অধিবেশনের বৈঠক হচ্ছে না। প্রথমদিনে অধ্যাদেশ উপস্থাপনসহ কিছু কার্যক্রম আছে সেগুলো অনুষ্ঠিত হবে। পরের দিন বিশেষ অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হবে। ওইদিন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন।
জানা গেছে, করোনাকালে অনুষ্ঠিত বিগত তিনটি অধিবেশনে গণমাধ্যমকর্মী এবং কোনো অতিথির বৈঠকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। তবে বিশেষ অধিবেশনে যেদিন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন সে দিন কিছু অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। একইসঙ্গে ৪০ জন গণমাধ্যমকর্মীদক সুযোগ দেয়া দেয়া হবে। রোনাকালীন অনুষ্ঠিত তিনটি অধিবেশনের মতো বিশেষ অধিবেশনেও রোস্টারভিত্তিক সংসদ সদস্যরা সংসদে প্রবেশ করবেন। এক্ষেত্রে তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে অধিবেশনে প্রবেশ করতে হবে। তবে বিশেষ অধিবেশনের যে বৈঠকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন, সে বৈঠকে রোস্টারের ভিত্তিতে প্রবেশ করতে হবে না। কোভিড-১৯ পরীক্ষায় নেগেটিভ ফলাফল আসা সব সংসদ সদস্য এদিন প্রবেশ করতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধুর সহচর সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, এটাই হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম বিশেষ অধিবেশন। আমরা সংসদ সদস্যরা জাতির জনকের জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা করব। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন, তার আদর্শসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সাড়ম্বরে উদযাপনে এ বছরকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে নানা কর্মসূচি নিয়েছিল সরকার। তার অংশ হিসেবে গত ৯ জানুয়ারি সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এই বিশেষ অধিবেশন করার সিদ্ধান্ত হয়। কথা ছিল, ২২-২৩ মার্চ এই বিশেষ অধিবেশন হবে। অধিবেশনের শুরুতেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ভাষণ দেবেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হবে। কিন্তু বিশ্বের অন্য সব দেশের মত বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকলে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হয়, সংসদের বিশেষ অধিবেশনও স্থগিত হয়ে যায়।
দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করায় সেই বিশেষ অধিবেশন বসানোর আলোচনা শুরু হয় গত সেপ্টেম্বর মাসে। সে সময় প্রস্তুতিমূলক বৈঠকও করে সংসদ সচিবালয়। এর আগে ১৯৭৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ও ১৮ জুন সংসদে যে বিশেষ বৈঠক বসেছিল, সেখানে যুগোস্লাভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি বরাহগিরি ভেঙ্কট গিরি ভাষণ দিয়েছিলেন। এবার মার্চে যে বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল, সেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্পিকারদের আমন্ত্রণ জানানোর কথা ছিল; কিন্তু তখন তা স্থগিত হয়। এবার নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার পরও বিষয়টি আলোচনায় আসে; তবে মহামারী পরিস্থিতির কারণে তা আর এগোয়নি।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল সুরক্ষা নিয়ে আমরা অধিবেশন আয়োজন করব। একাদশ জাতীয় সংসদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালন করতে যাচ্ছে। এটা এই সংসদের জন্য গর্বের বিষয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ১০টি কর্মসূচি নিয়েছে জাতীয় সংসদ। এরমধ্যে এখন বৃক্ষ রোপণ চলছে। নভেম্বরে মুজিববর্ষের ওয়েবসাইট উদ্বোধন, স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন, ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস উদযাপন, মাসব্যাপী আলোকচিত্র ও প্রামাণ্য দলিল প্রদশর্নী, ‘সংসদে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে একটি বইয়ের প্রকাশনা এবং শিশুমেলাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। সংসদ কক্ষে স্পিকার যেখানে বসেন, তার পেছনে উপযুক্ত জায়গায় জাতির জনকের প্রতিকৃতি মর্যাদার সাথে প্রদর্শন ও সংরক্ষণ করার আদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। গত অগাস্ট মাসে হাই কোর্টের দেওয়া ওই আদেশের কপি পাওয়ার পরপরই অধিবেশন কক্ষে ছবি টাঙিয়েছে সংসদ কর্তৃপক্ষ।
স্পিকার বলেন, আদালতের আদেশে আমরা ছবি টাঙিয়েছি। এর মধ্যে সংসদের অধিবেশন হয়নি। আসন্ন বিশেষ অধিবেশনই হবে প্রথম অধিবেশন, যেখানে সংসদ কক্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকবে। করোনাভাইরাস মহামারীর বিস্তারের পর এখন পর্যন্ত তিনটি অধিবেশনে বসেছে সংসদ। এর মধ্যে গত এপ্রিল মাসে বসে দেড় ঘণ্টার নিয়ম রক্ষার অধিবেশন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম। এরপর গত জুনে অষ্টম (বাজেট) এবং সেপ্টেম্বরে নবম অধিবেশন বসে। সংক্রমণ রোধে শেষ দুটি অধিবেশন বসেছে সীমিত সংখ্যক সদস্যকে নিয়ে, যাতে অন্তত কোরাম হয়। তালিকা করে, দিন নির্দিষ্ট করে আইন প্রণেতাদের সংসদে নেওয়া হয়েছে। তার আগে সবার করোনাভাইরাস পরীক্ষা হয়েছে। বয়স্ক সংসদ সদস্যদের অধিবেশনে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয়েছে সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও। তবে বিশেষ অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে সবাইকে থাকার কথা বলা হবে জানিয়ে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সেক্ষেত্রেও সবার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে হবে। আগামী ৩ নভেম্বর থেকে সংসদ সদস্যদের পরীক্ষা শুরু হবে। প্রথমদিন কোভিড-১৯ নেগেটিভ সকল মাননীয় সংসদ সদস্য অধিবেশনে অংশ নেবেন। এরপর থেকে আমরা আগের মত তালিকা করে অধিবেশন চালাব। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ অধিবেশন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কয়েকটি কার্যসূচি নেওয়া হবে।
এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জারি করা অধ্যাদেশে উপস্থাপন করা হবে আইন হিসেবে পাস করার জন্য। অধ্যাদেশ জারির পর সংসদের প্রথম বৈঠকে সেটি উপস্থাপন করার বিধান রয়েছে। এর ৩০ দিনের মধ্যে সেটি আইনে পরিণত করতে বিল আনারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এই অধিবেশনেই এ সংক্রান্ত বিল এনে তা পাস করাতে হবে।
সংসদ সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মহামারীকালের অন্য তিনটি অধিবেশনের মত এ অধিবেশনেও সংবাদকর্মীদের প্রবেশাধিকার থাকছে না। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবেশও সীমিত থাকবে।
জানা গেছে ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশন শুরু হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেওয়া ভাষণ দেখানোর মধ্য দিয়ে। এর আগে অবশ্য নিয়ম অনুযায়ী কোরআন তেলাওয়াত হবে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আয়োজিত জনসভায় দেয়া এই ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাতির পুননির্মাণ, সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে ছিলো অত্যন্ত সময়োপযোগী। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষন দেখানোর পরই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে স্মারক বক্তৃতা রাখবেন।
স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রকৃত লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সে ভাষণেরই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণে বলেন, “বাংলার মানুষ আজ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। অনেক কাজ আছে যা করা জরুরী।” রোববার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে স্পিকার বলেন, এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শোষণ-বৈষম্য থেকে জনগণের মুক্তি অর্জনকে তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন হিসেবে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। এসব কারনে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ দিয়েই বিশেষ অধিবেশন শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সুত্র: দৈনিক সময়ের আলো।