সংসদ প্রতিবেদক:
জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দিয়ে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ উপহার স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। সেই বঙ্গবন্ধুকে যারা ইতিহাস থেকে মুছতে চেয়েছিলেন তারাই এখন ইতিহাস থেকে মুছে গেছেন। এখন সোনার বাংলাকে তার আদর্শের আলোকে গড়ে তুলতে হবে প্রিয় বাংলাদেশকে। বন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দেশকে উন্নত দেশে পরিণত কাজ করতে হবে। রোববার রাতে জাতীয় সংসদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি একথা বলেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ওই আলোচনায় তিনি বলেন, এই দেশের গণমানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে। তিনিই আমাদের অন্ধকারের মধ্যে আলো দেখিয়েছেন। এখন তাঁর দেখানো আলোতেই, আমরা পথে হাঁটছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতু, রুপপুর পারমানবিক কেন্দ্রের মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মকাণ্ড চলছে। বক্তব্যের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বেগম রওশন এরশাদ। সেটা ছিলো ১৯৭৪ সালের শেষ দিকের। তিনি বলেন, এই মহামানবের সঙ্গে একই প্লেনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকা কর্ণেল জামিল এসে আমাকে বলেন, ভাবি বঙ্গবন্ধু আপনাকে ডাকছেন। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বঙ্গবন্ধু তখন শুয়েছিলেন। আমাকে দেখে উঠে বসতে গেলে বললাম, আপনি উঠবেন না। শুয়ে থাকেন, আমি আপনার মাথার কাছে বসছি। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তিনি আমার মা-বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে প্রাণ ভরে আশির্বাদ করলেন। সেদিন দেখা না হলে অনেক কিছুই অজানা থাকতো।
বঙ্গবন্ধুর নানান সাহসী বক্তব্যের উদ্বৃতি দিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি যদি কখনো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযোগ পাই তাহলে সেই শাসনতন্ত্রে এই প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁর অনুভূতি ছিলো অত্যন্ত গভীর। তাঁর এই গভীর অনুভূতি দেখে আশ্চার্য হয়ে যেতাম। গরীব-দুঃখী মেহনতি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হারানো কষ্টের কথা তুলে ধরে রওশন এরশাদ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা না করলে তিনি এখন শতায়ু হতেন হয়তো। তাইতো কেবলই বিখ্যাত একটি গান মনে হয়, যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই…. আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা, বিশ্ব পেতো ফিরে এক মহান নেতা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গেলে আমার কান্না চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্খা থেকে অনেক দুরে। তবে আশার কথা, তাঁর যে রাজনৈতিক দর্শন তার প্রতিফলন দেখতে পাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী দিনরাত প্রায় ২৪ ঘন্টা কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সফলতা কামনা করি।
বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, মাননীয় স্পিকার,
আপনাকে ধন্যবাদ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী-তে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহবান এবং সংসদে এসে ভাষনদানের জন্য আমি আপনার মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে জানাচ্ছি সশ্রদ্ধ অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। মাননীয় সংসদ নেতা যে বিশেষ প্রস্তাব এনে এদেশবাসীকে সম্মানিত করেছেন, ঐ মহামানবের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন- সেজন্য তাঁকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ। মাননীয় স্পিকার, এই বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষে আপনাকে জানাচ্ছি অসংখ্য ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
মাননীয় স্পিকার,
বক্তবের শুরুতেই আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহিদদের।
“শতবর্ষের সাক্ষী তুমি হে মহান
জন্ম তোমার ইতিহাস হবে
দেশ হবে মহীয়ান
তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান…..”
মাননীয় স্পিকার,
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে প্রাণ না হারাতেন ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তিনি শতায়ু হতেন। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা স্বাধীনতার অর্ধ-শত বার্ষিকীতে পদার্পণ করবে।
কি আশ্চর্য এক মিলের সেতু বন্ধন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালিকে জাতি হিসেবে আমরা মাত্র ৫৫ বছর ৪ মাস বাঁচতে দিয়েছি। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে শতায়ু তিনি হতেন না, তা কে বলতে পারে? যদি তিনি তাঁর অতি প্রিয় বাংলার মাটিতে শতবর্ষ বেঁচে থাকতেন তবে এই দিনটি জাতি তখন কীভাবে পালন করত, তা ভাবলে মনেপ্রাণে শিহরণ জাগে!
সেই উপলব্ধি থেকেই হয়তো বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২০২০-২০২১ খ্রীস্টাব্দকে মুজিব বর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এই হলো পটভূমি। যে দেশটির জন্য তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন, যে দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের কথা নিয়েই যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আত্মনিয়োজিত ছিলেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘোষিত “মুজিব বর্ষ”টি তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
মাননীয় স্পিকার,
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত বংশে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন ‘খোকা’। টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা দিনে দিনে, অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যদিয়ে, বাংলার মানুষের ভালবাসায় সিক্তহয়ে হয়ে উঠেন বাংলার বন্ধু- বঙ্গবন্ধু।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ছিল পরাধীনতার। হাজার বছরের সেই গ্লানি থেকে এ জাতি মুক্ত হয়েছে যাঁর নেতৃত্বে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাইতো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।
আজ সেই মহান ব্যক্তির জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে, গোটা জাতির জন্য এ এক আনন্দঘন সময়। জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বঙ্গবন্ধুকে। আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাঁর প্রতি জানাই পরম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা।
মাননয়ী স্পিকার,
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হওয়া কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এমন নয় যে, বাঙালি হঠাৎ করেই পেয়ে গেছে তাদের স্বাধীন ভূমি। প্রকৃতপক্ষে বাঙালির জন্য একটি নিরাপদ, শোষণ মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই। ছাত্রাবস্থাতে তাই তিনি জড়িয়ে ছিলেন রাজনীতিতে।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন- “আমি যদি কখনও পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযোগ পাই; তবে এ প্রদেশের নামকরণ করব বাংলাদেশ”।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এ দেশের বুক থেকে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই জনগণের পক্ষ হতে আমি ঘোষণা করছি, আজ হতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা উল্লসিত কণ্ঠে রণধ্বনি তুলে বলে উঠল- বাংলাদেশ; বাঙালির বাংলাদেশ। এ নিয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার পরবর্তী সময়ে গান লিখেছেন- শোন একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণী/ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। ’৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা- বাঙালিকে স্বাধীনতার পথে হেঁটে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন সেতু- ছয় দফা। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে উন্নীত হওয়ার জন্য। ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি যেমন সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব; ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাস যেমন ম্যাগনাকার্টা আর বাঙালি জাতির ভিত্তি হচ্ছে ছয় দফা। ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন, ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণতন্ত্রের অতন্দ্রসৈনিক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য এক বিশাল ইতিহাস। অতি অল্প সময়ে সেই ইতিহাসের একাংশও হয়তো তুলে ধরতে পারবোনা আমি। আমি এদেশের একজন নাগরিক হিসাবে একজন জনপ্রতিধি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তাঁর প্রতি বিনম্র শদ্ধা জানাতে এখানে দাড়িয়েছি।
মাননীয় স্পিকার
বাঙালি বঞ্চনা-শাসন ও দাসত্বের শেকলে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে হাজার হাজার বছর; মননশীলতার গভীরতম প্রদেশে ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা, আতঙ্ক যেন একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। অপরদিকে মুক্তচিন্তা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ক্রমশ বিলীয়মান হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর এককথায় সব ভয় ও সংকীর্ণতা তাড়িয়ে বাঙালি আবদ্ধ শেকল থেকে মুক্ত হয়ে লিখেছে মুক্তির কবিতা, মুক্তির ছড়া, মুক্তির গান- মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি; কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট, শিকল পূজার পাষাণ-বেদী ইত্যাদি।
এতে উদ্বেলিত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। টগবগ করে ফুটে উঠেছিল বহু বছরের জমে থাকা অব্যক্ত ক্ষোভ। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধু- বাংলার কৃষক, শ্রমিক, নারী, পুরুষ, ছাত্র, যুবক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, ডাক্তার এবং সর্বস্তরের মানুষকে দিয়েছেন গৌরবান্বিত ইতিহাস রচনার নতুন অধ্যায়।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন রাষ্ট্রে সেটা ছিল তাঁর জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।
সেই চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেছিলেন ইতিহাসেরই দায় থেকে। সফলও হয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রের অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরুকরে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি আদায়- প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
মাননীয় স্পিকার,
মুজিব বর্ষ উদযাপনের সময় এই কথাটি মনে রাখা দরকার যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু তাঁর সন্তানদের গর্বিত পিতা নন। তিনি বাঙালি জাতির পিতা। তিনি বিশেষ কোন দলের নেতা নন। তিনি সকল বাঙ্গালীর নেতা। অতি আবেগ কিংবা বিশেষ যড়যন্ত্র- যে কারনেই হোক না কেন, বঙ্গবন্ধুকে যারা বিশেষ অঞ্চল, গোষ্ঠী বা দলের নেতা হিসেবে তুলে ধরার অপপ্রয়াস নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের সে অপচেষ্টাকে ব্যর্থ প্রমাণিত করেছে। বঙ্গবন্ধুকে যারা ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন, আজ তারাই ইতিহাস থেকে মুছে গেছেন। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা ও সোনার মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাত কোটি বাঙালীর মানুষ হতে না পারার কবিগুরুর আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণ করে তিনি বাঙালীকে মানুষ করতে পেরেছিলেন এবং দেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, অন্যের দ্বারা শাসিত-শোষিত বাঙালীকে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা, স্বশাসন ও শোষণমুক্তি তথা নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার অধিকার আদায় করে দিয়ে গেছেন। এর চাইতে মহৎ কর্ম আর কী হতে পারে ?
মাননীয় স্পিকার,
আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে আমরা যদি নিজেদের দিকে তাকাই তাহলে অবশ্যই বলতে হবে, সেই আখাঙ্খিত মুক্তির চূড়ান্ত গন্তব্য থেকে এখনো আমরা অনেক দূরে অবস্থান করছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১১ বছর বাংলাদেশ সেই মুক্তির পথে দুর্গম গিরি অতিক্রমের চেষ্টা করছে। উল্লেখযোগ্য বহু অর্জন আছে আমাদের। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-সহ বড় বড় সব আর্থিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নজর এখন বাংলাদেশের দিকে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হারে চীন-ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। নিজেস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ একটি প্রকল্প। বাস্তবায়িত হচ্ছে কর্ণফুলি নদীগর্ভে ৩.৪৩ কি.মি. টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ ১০ টি মেগা প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু-নির্ধারিত মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বহু পথ এখনো হাঁটতে হবে। সামনের সেই পথ অত্যন্ত কঠিন ও শ্রমসাধ্য।
আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শসংবলিত একটা জাতীয় মানসকাঠামো তৈরি করতে পারি, তাহলে দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও সুশৃঙ্খল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজনমুক্ত একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বড় কোনো বাধা আর থাকবে না ইনশাআল্লাহ।
মাননীয় স্পিকার,
একবিংশ শতাব্দীর এ পর্যায়ে এসে আজও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রাসঙ্গিক আমাদের জন্য। তিনি চেয়েছিলেন একটি শোষণহীন, বৈষম্যহীন উন্নত সমাজ গড়তে। একইসঙ্গে তিনি লালন করতেন উন্নত গণতান্ত্রিক চেতণা। তাঁর এই আদর্শের আলোকেই আজ গড়ে তুলতে হবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। অসাম্প্রদায়িকতাসহ তাঁর জীবনাদর্শকে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। দেশে রাজনৈতিক ভিন্নমত রয়েছে, সেটা থাকতেই পারে। আমরা রাজনীতি করি। আমাদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ, রাজনৈতিক দর্শন, দলীয় আদর্শ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু যে মানুষটির জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতোনা, যে মানুষটির জন্ম না হলে বাঙ্গালী পেতোনা মুক্তির স্বাদ, যে মানুষটির দেশপ্রেম ছিলো প্রশ্নাতীত, যিনি কেবল মানুষকে ভালবাসতেন- পরিবার, দল আর মতাদর্শের উদ্ধে ছিলো তার মানবিক দর্শন। সেই মহামানবের বিষয়ে কেবল একটিই অনুভূতি প্রকাশ করা সমীচীন- যার নাম ভালবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
মাননীয় স্পীকার,
আমি খুব দু:খ পাই, লজ্জায় অবনত হই, যখন ভিন্ন কিছু দেখি, শুনি। পিতা-কে প্রতিপক্ষ করে-কেউ বড় হতে পারেনা- পারবেনা। অকৃতজ্ঞের খাতায় নাম লেখাবে কেবল তারা। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, তিনি কেবল শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার পিতা নন- তিনি বাঙ্গালি জাতির পিতা। জীবিত বঙ্গবন্ধু একজন রক্ত- মাংশের মানুষ ছিলেন- মানুষের ভূল হতেই পারে। কিন্তু মানবীয় সকল ত্রুটি-ছাপিয়ে উঠে- মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা, দেশের জন্য তাঁর সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, সর্বোপরি আমাদের দিয়ে যাওয়া তাঁর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ উপহার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
স্বাধীন দেশে আজও তাঁর আলোতেই পথ চলি আমরা। সে পথ যতই ভিন্ন হোক -একে অপরের থেকে, আলো কিন্তু তাঁরই। আজ আমি বামে, আপনি ডানে। আসন যদি বদলায়ও একদিন পিতার ছবি মাঝখানে, উপরেই থাকবে ইনশাল্লাহ। তাই থাকা উচিত। সকলেরই এ কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
মাননীয় স্পিকার,
করোনা মহামারির এই দুর্যোগের দিনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আপনি যে, সাহসী, সময়োপযোগী, সুন্দর ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করেছেন সেজন্য আপনাকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
মাননীয় স্পিকার,
সর্বশেষে, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের দরবারে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের শান্তিময় পারলৌকিক জীবন দান করেন।
মাননীয় স্পিকার,
আপনার মাধ্যমে আমি সংসদ নেতা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ। সংসদ পরিচালনায় আন্তরিক অবদান রাখার জন্য আমি মাননীয় ডেপুটি স্পিকার, সংসদ উপনেতা, সরকারী দলের চীফ হুইপ, হুইপগণ, বিরোধীদলীয় উপনেতা, বিরোধীদলীয় চীফ হুইপসহ সকল মাননীয় সংসদ সদস্যকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। সংসদ সচিবসহ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী, পুলিশ বিভাগ, ফায়ারসার্ভিস, গণপূর্ত বিভাগ, সংসদ মেডিকেলর সকল চিকিৎসকগণ এবং সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
মাননীয় স্পিকার,
পরিশেষে আপনার সুস্বাস্থ্য ও কর্মময় আগামীর প্রত্যাসা রেখে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
মাননীয় স্পিকার,
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি যার সুনিপন হাত ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কণ্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইহা ইতিহাসের এক অমেঘ সত্য যে, জাতির পিতার জন্মশত বর্ষ তথা “মুজিব বর্ষ” উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে তাঁরই কণ্যার হাত ধরে। এবারের এই বর্ষকে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় করতে, জাতির পিতার প্রজ্জ্বলিত দীপ্ত শিখা তথা সমুজ্জ্বল আলো বাংলার ঘরে ঘরে ছড়াতে বাঙালির এবারের অঙ্গীকার ছড়িয়া যাক বাংলার মাঠ-ঘাট প্রান্তর, আকাশে-বাতাসে-এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
মাননীয় স্পিকার,
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীতে ঘোষিত ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষ্যে একাদশ জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন বর্তমান সংসদের ১০ম অধিবেশন- যা সংসদীয় ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আর মুজিব বর্ষের বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষ্যে জাতীয় সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এজন্য আমি জাতীয় সংসদ, সংসদ সচিবালয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এক মাসের সম্মানী ভাতা প্রদানের জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।