গাড়ি পোড়ানোর বিষয়ে বিএনপি নেতার পরিকল্পনার রেকর্ড সংসদে বাজিয়ে শোনালেন প্রধানমন্ত্রী

কয়েক দিন আগে রাজধানীতে বাসে আগুন দেওয়া নিয়ে বিএনপি নেতারা সরকারের ওপর দোষ চাপানোর কড়া জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার রাতে সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেছেন, আমরা ক্ষমতায় আছি, আমরা আগুন দিয়ে আমাদের সরকারকে বদনামের ভাগিদার করব কেন? আর মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এখন সব জায়গায় সিসিটিভি আছে। কারা আগুন দিচ্ছে পরিষ্কার ছবি আছে আমার কাছে। ছবি দেখানোর সুযোগ থাকলে সেটাও দেখাতে পারি। বাসে আগুন দেওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে সরকার প্রধান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তারা কষ্টে আছেন। এই সুযোগে বিএনপি চাচ্ছে— মানুষের দুঃসময়টাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বদনাম করতে। নিজেরা ফায়দা লুটতে। তবে মানুষ এখন অন্ধ নয়। তারা সব দেখে-জানে।’

সোমবার রাতে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদ সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে বলেন, গাড়ি পোড়ানোর ইস্যু নিয়ে বিএনপি নেতাদের অহেতুক দোষ চাপানো হচ্ছে। তিনি এরজন্য সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান। তার বক্তব্যের পর স্পিকারের অনুমতি নিয়ে সংসদে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বক্তব্য দেওয়ার আগে শেখ হাসিনা বাসে আগুন দেওয়া ইস্যুতে বিএনপি নেতা নিতাই রায় চৌধুরী ও দলের একজন নারী নেত্রীর টেলিফোনের কথোপকথনের অডিও সংসদে বাজিয়ে শোনান। সংসদ নেতা স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বিএনপি নেতাদের ফোনকল রেকর্ড শোনান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন টেকনোলজি এসে গেছে, টেকনোলজি অনেক এগিয়ে গেছে। টেকনোলজি কথা বলবে। এরপর ফোন রেকর্ড প্রধানমন্ত্রীর মাইক্রোফোনের সামনে দিয়ে শোনান। সেই ফোন রেকর্ডে শোনা গেছে ফরিদা নামে এক নারী নেত্রী বলছেন, আদাব, ফরিদা বলছি..পার্টি অফিসে তো আটকে পড়েছিলাম, এতোক্ষণ গাড়ি পোড়াইছে ছেলে-পেলে। অপর প্রান্ত থেকে একজন সিনিয়র নেতা বলছেন, গাড়ি পোড়া হয়েছে, এগুলো কোনো জায়গায়? এরপর ফরিদা বলছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। অপর প্রান্ত থেকে বলছে, কোন জায়গা? আবার ফরিদা বলছেন, এই যে পার্টি অফিসের সামনে। এখানে পুলিশ র‌্যাব এসে পার্টি অফিস ঘেরাও করে রেখেছে। কোনো রকম সাংবাদিকদের সহযোগিতায় বের হয়েছি আমি। আমি তো যেতে চেয়েছিলাম যেতে পারলাম না। অপরপ্রান্ত থেকে বিএনপির ওই সিনিয়র নেতা বলছেন, গাড়ি কোন জায়গায় পুড়েছে? এরপর ফরিদা বলছেন, পুলিশের স্টাফ গাড়ি থাকে না। ওগুলোতে আগুন দিয়েছে যুবদলের ছেলেরা। কোন জায়গায়? পার্টি অফিসের সামনে, কয়টা? একটা, একটা গাড়ি, হ্যাঁ একটা গাড়ি। পুলিশ আসছে, র‌্যাব আসছে। শনিবার দিন যোগাযোগ করে আসবো নে.. আপনার সাথে কথা ছিল।

পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়। বিএনপির উনাকে (হারুনকে) আমার সামনের সিটেই বসিয়েছি, উনি কথা বলেন। উনি বিভিন্ন সময় এমন এমন কথা তোলেন, সবসময় আমরা কথার উত্তরও দেই না। আমার মনে হয় আজকে উনি যেভাবে কথাটা বললেন, আমার মনে হয় নিজেদের পার্টি সম্পর্কে তথ্যগুলো জেনে নিয়ে তারপর কথা বলা উচিত ছিল। বিএনপির সংসদ সদস্য হারুন সাহেব নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আদৌ তারা কি নির্বাচন করে কি না? নির্বাচনে উনারা অংশ নেন, নমিনেশন নিচ্ছেন, যাচ্ছেন কিন্তু তাদের না আছে প্রচার, না কাজ বা নির্বাচনের দিনে কোথাও একটা এজেন্টও ঠিকমত দেবে না, কোনো কিছু করবে না। স্পিকার যদি প্রতিটি উপ-নির্বাচন দেখেন একটা সময়ের পর তারা নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করেই অমনি বলে নির্বাচন ঠিক হচ্ছে না। আসলে তারা জনগণের সমর্থন তারা হারিয়েছে অনেক আগেই। ২০০১ সালে চক্রান্ত করে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা যে সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, বিশেষ করে তাদের সন্ত্রাস, মানুষ খুন করা, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নাই ২০০১ সালে বিএনপি করে নাই। একেবারে সেই ১ অক্টোবর থেকে শুরু হাজার হাজার মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করা। তারপর আসে তাদের অগ্নিসন্ত্রাস। জীবন্ত মানুষগুলোকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এখনো আমাদের পার্লামেন্টের মেম্বার আছে, কোনো অপরাধ ছিল না অগ্নিসন্ত্রাস করে তারা মানুষ পোড়াল। এটা তাদের একটি আন্দোলন, মানে মানুষ খুন করা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুটি আসনে উপ-নির্বাচন হলো। ঢাকায় যখন একটি আসনে নির্বাচন হচ্ছে চট করে কয়েকটা বাসে আগুন দেওয়া এবং তারা নিজেরা আগুন দিয়ে আবার দোষ দিচ্ছে এটা নাকি সরকারি এজেন্ট করেছে। মাননীয় স্পিকার আমরা ক্ষমতায় আছি, আমরা আগুন দিয়ে আমাদের সরকারকে বদনামের ভাগিদার করব কেন? মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। তিনি বলেন, এখন টেকনোলজির কারণে সব জায়গায় সিসিটিভি আছে, সেখানে তো হাতে নাতে ধরা পড়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় কারা সত্যি আগুণন দিচ্ছে এবং একেবারে পরিষ্কার ছবি আছে আমার কাছে। ছবি দেখানোর সুযোগ থাকলে সেটাও দেখাতে পারি। তাদের একটা মিছিল চলে যাওয়ার সাথে সাথে কয়েকটা লোক দেখা গেল দিয়াশলাই দিয়ে বাসের মধ্যে আগুন দিয়ে দিল। সেই ছবি আমার কাছে আছে। রাস্তায় যে ভিডিও ফুটেজ থেকে বিশেষ করে সিসি ক্যামেরা থেকে নেওয়া। নিজেরা আগুন দিয়ে এসে পার্লামেন্টে সরকারকে দোষারোপ করা উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো। এটা তাদের অভ্যাস। তিনি বলেন, আসলে তো তাদের গোড়ায় গলদ। গোড়ায় গলদটা হচ্ছে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছে হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। তারপর প্রত্যেকটা ঘটনা যদি দেখেন তার ক্ষমতা দখলটাই খুনের মধ্যে দিয়ে। যে দলটি সৃষ্টি করে গেছে তারা ওই খুন খারাপি অস্ত্রের রাজনীতি এটাই ভালো বোঝে।

বাস পোড়ানো প্রসঙ্গে সংসদ নেতা বলেন, কোনো কারণ নাই এভাবে বাসে আগুন দিয়ে পোড়ানোর, কিন্তু তারা করল, কেন? নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। যখন মানুষের ভোট পাচ্ছে না। মানুষের আস্থা বিশ্বাস হারিয়েছে আর হবেই বা না কেন, দলের নেতা বানিয়েছে কাকে? খুনের মামলার আসামি। দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারির মামলায় যিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি, যে দেশ থেকে পলাতক তাকে বানানো হল ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বাংলাদেশে বিএনপির এমন কোনো যোগ্য নেতা নাই যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হতে পারে। তাদের যিনি নেত্রী তিনিও এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। তারপর তাকে বাসায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। কাজেই এই অপরাধের মধ্য দিয়ে যাদের জন্ম আর অপরাধ করাটাকেই যারা নিয়ম মানে তারা আর যাই হোক মাননীয় স্পিকার সংসদ একটা পবিত্র জায়গা আমি আপনার মাধ্যমে বিএনপি সংসদ সদস্যকে বলব এভাবে এখানে অসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত না করাই ভালো। এটা মানুষ গ্রহণ করবে না। মানুষ বিশ্বাস করবে না।
তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যেন বিএনপি বন্ধ করে এটাই আমার আবেদন থাকবে। আমরা দেশের উন্নয়ন চাই। করোনাভাইরাসে এমনি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, মানুষ কষ্টে আছে, আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। মানুষকে সাহায্য করে যেতে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে আর এই সুযোগে তারা মানুষের দুঃসময়টাকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে বদনাম করতে চাইছে। মানুষ এখন অন্ধ না, মানুষ সব দেখে, জানে, আর একথা বিএনপি নেতাদের বোঝা উচিত। টেকনোলজির কারণে এখন অনেক কিছুই খুব তাড়াতাড়ি ধরা পরে যায়। আজকে বিএনপির সংসদ সদস্য আমি মনে করি একথা শোনার পর বোধ হয়

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির হারুন বলেন, ‘সংসদনেতা প্রধানমন্ত্রী রোববার সংসদে গাড়ি পোড়ানোর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না।’ ওই ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলা হয়েছে। পুলিশের পেশাদারিত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন আসছে। পত্রিকায় এসেছে, মামলার কথা বাদী জানেই না। পুলিশ বলছে, ভিডিও ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, ইশরাক হোসেন কোভিড আক্রান্ত। জুয়েল কোভিড আক্রান্ত। আমাদের ছাত্রদলের আরেকজন নেতা চেন্নাই হাসপাতালে এক বছর ধরে চিকিৎসধীন। তারা কী করে মামলার আসামি হয়? মুদিখানার দোকানে একজন বসেছিলেন, তাকে আসামি করা হয়েছে। এটা জুলুম। অন্যায়। স্পিকারকে উদ্দেশ করে বিএনপির এই এমপি বলেন, ‘আমি অনুরোধ করবো, একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করুন। সরকারি দলের যাকে যাকে খুশি আপনি রাখেন। বিরোধী দলের তিন জন সদস্য রাখেন। ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত সাত দিনের মধ্যে এই তথ্য উৎঘাটিত হওয়া দরকার এবং এটি জাতির সামনে উপস্থিত হওয়া দরকার।’

 

Print Friendly, PDF & Email