জিয়ার সমাধি সরাতে গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা

রফিকুল ইসলাম সবুজ:
লুই আই কানের নকশা অনুসরণ করে সংসদ ভবনের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মিত সংসদ ভবনের ভেতরের কাঠের তৈরি বিভিন্ন কক্ষ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মিত অন্যান্য স্থাপনাও সরিয়ে ফেলা হবে বলে জানিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। তবে সংসদ ভবন এলাকা থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিসহ নকশাবহির্ভূত ৭টি কবর উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে সংসদ সচিবালয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিষয়টি যেহেতু স্পর্শকাতর তাই সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্ত পাওয়ার আগে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিতর্ক এড়াতে শুধু জিয়ার কবর নয়, নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনও উচ্ছেদ করা হতে পারে। এ বিষয়ে সংসদ সচিবালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে তা বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

লুই কানের নকশা অমান্য করে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতরে ও বাইরে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। বিশেষ করে সংসদ ভবনের ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার পথ বন্ধ করে তৈরি করা হয়েছে কক্ষ। সংসদ সচিব, বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের একান্ত সচিবসহ কর্মকর্তাদের এসব কক্ষ তৈরি হয়, যা মূল নকশায় নেই। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ৭ ও ৯ তলা ছাড়া নকশাবহির্ভূত কাঠের তৈরি কক্ষ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিকল্প অফিসের ব্যবস্থা করার পর ৭ ও ৯ তলার অবৈধ স্থাপনাও সরিয়ে ফেলা হবে।
২০১৪ সালে লুই কানের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংসদ ভবনের মূল নকশা আনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর লুই কানের প্রতিষ্ঠান ডেভিড অ্যান্ড উইজডমের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে স্থাপত্য অধিদফতর। নকশাগুলো পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচারাল আর্কাইভে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে সেখানেও যোগাযোগ করা হয়।

গণপূর্ত অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের মহাফেজখানা থেকে লুই কানের তৈরি করা ৮৭৩টি নকশা ও ৫৫টি ডকুমেন্ট ঢাকায় আসে। ৪১টি বাক্সে মোট চার সেট নকশা আনা হয়। পেনসিলভানিয়া ইউনির্ভাসিটি থেকে এগুলো খুঁজে বের করতে ৩ হাজার ৫৫০ মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। ঢাকায় আনার পর লুই আই কানের তৈরি করা জাতীয় সংসদ ভবন ও প্রস্তাবিত সচিবালয় এলাকার মূল নকশার বিন্যাসের কাজ শেষ করেন স্থপতিরা। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নকশার একটি কপি জাতীয় আর্কাইভে হস্তান্তর করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলে আসায় বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে চলমান জাতীয় সংসদের প্রথম বাজেট অধিবেশনে বক্তৃতাকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে ফেলার দাবি জানান। এর পরপরই নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংসদ ভবন এলাকা থেকে লুই আই কানের নকশাবহির্ভূত স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সব প্রস্তুতি রয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের। তবে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে সরকারের শীর্ষমহল থেকে। আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নকশার একটি করে সেট হস্তান্তরের পর সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করা হবে। শিগগিরই এটা করা হবে বলে জানা গেছে।

সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৪ সালে লুই আই কান যখন মূল নকশাটি করেন, তখন ২৭টি মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পরিকল্পনা করেন। তখন সেখানে মসজিদ ছিল, মাঝে বাগান ছিল, চন্দ্রিমা উদ্যানের ওখানে একটি বড় সড়ক ছিল, এর সামনে লেক ছিল, এরপর সংসদ ভবন ছিল। ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ ছিল নকশার প্রথম ধাপ। যার সামনে ও পেছনেও বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক ও মাঝখানে লেক। দ্বিতীয় ধাপে আছে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এ ছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়। কিন্তু নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ইতোমধ্যে ওই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে মাজার ও কবরস্থান। সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মাঝে বিশাল এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার কমপ্লেক্স। আর সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া স্থানে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে ‘কবরস্থান’ নাম দিয়ে সাতজনকে সমাধিস্থ করা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খানের কবর রয়েছে সেখানে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নকশা উপেক্ষা করে আসাদগেটের উল্টো দিকে অবস্থিত সংসদ ভবনের জায়গায় স্থাপন করা হয় পেট্রোল পাম্প। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশে খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবনও নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন সময় সংসদ অধিবেশনে আলোচনায় এসব অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ফেলার দাবি ওঠে। প্রাপ্ত নকশা অনুযায়ী অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে বলে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন একাধিকবার জানিয়েছিলেন।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী জানান, সংসদ ভবনের ভেতরে নকশা অনুসরণ করে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। জিয়ার সমাধিসহ নকশাবহির্ভূত সংসদ এলাকার অন্যান্য স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আশা করছি সংসদ ভবন এলাকায় কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকবে না।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, জাতীয় সংসদ ভবনের স্থাপত্যশৈলী আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দিত। সংসদকে লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী সাজানোর বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে তার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী এ কাজ সম্পন্ন করা হবে।

সুত্র: দৈনিক সময়ের আলো।

Print Friendly, PDF & Email