নিজস্ব প্রতিবেদক:
দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে দল-মতের পার্থক্য ভুলে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।
সোমবার জাতীয় সংসদের বছরের প্রথম অধিবেশনের ভাষণে রাষ্ট্রপতি এ আহ্বান জানান। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানান। সংসদ কক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রবেশের পর জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
সংসদে রাষ্ট্রপতির জন্য স্পিকারের ডান পাশে লাল রঙের চেয়ার সংরক্ষণ করা হয়। এ সময় অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্ত অংশ সংসদে পাঠ করেন। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী প্রতিবছরের মতো এবারও রাষ্ট্রপতি সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম ও উন্নয়ন তুলে ধরে ভাষণ দেন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আসুন, দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। গণতন্ত্রায়ন, সুশাসন ও নিরবচ্ছিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রায় সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। আমি সরকারি দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই।
রাষ্ট্রপতি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ‘মুজিববর্ষ’-এর উপহার হিসাবে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৪ হাজার গৃহ নির্মাণ করে বিনামূল্যে অসচ্ছল ও গৃহহীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদান করার লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন’ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে এবং ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন শীর্ষক’ প্রকল্প ও ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্যানোরমা নির্মাণ’ প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা আজ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দারপ্রান্তে। শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই আমাদেরকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। এ বছর মধ্য-আয়ের দেশ হিসাবে আমরা ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ পালন করবো। তবে, আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়া। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আপামর জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা একটি কল্যাণমূলক, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সক্ষম হবো।
ভাষণে রাষ্ট্রপতি অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন। এছাড়া দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে সব ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। সম্প্রতি সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সাফল্যের সঙ্গে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজার ৫৪ জন নার্সকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ১০ হাজার ৫২৫টি সাধারণ বেড, ৬৬৬টি আইসিইউ এবং ৭৩টি ডায়ালাইসিস বেড, ৫৫৪টি ভেন্টিলেটর, ১৩ হাজার ৫১৬টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৬৭৮ হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা এবং ৬৩৯টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
করোনা টিকা দ্রুত সরকার দিতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিকেলস লিমিটেড এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব লাইফ সাইনসেস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সিএমএসডি’র মাধ্যমে জরুরিভিত্তিতে ভ্যাকসিন ক্রয় বাবদ ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেওয়া হয়। আমি আশা করছি, সরকার খুব শিগগিরই দেশের জনগণকে করোনা টিকা দিতে পারবে।
তিনি বলেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষসাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্বনীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত এক দশকে গড়ে ছয় দশমিক ছয় শতাংশ ও পর পর তিনবছর সাত শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট দশমিক এক-পাঁচ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এ ধারাবাহিক অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। করোনা মহামারিতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক দুই-চার শতাংশে। তবে একইসময়ে মাথাপিছু জাতীয় আয় আট দশমিক এক-দুই শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। আইএমএফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আরও বলেন, ভিশন ২০২১ এর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা এবং ভোটদান প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য করেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৬টি আসন, জাতীয় সংসদের ৪টি উপ-নির্বাচন এবং স্হানীয় সরকারের বিভিন্ন উপ-নির্বাচন ইভিএম-এর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট গ্রহণে সনাতন ব্যালট পেপার পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক স্বচ্ছ প্রযুক্তি নির্ভর এ পদ্ধতিটির প্রয়োগ ছিল সময়ের সারণীতে সঠিক সিদ্ধান্ত। ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে স্বচ্ছতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে।