সংসদ প্রতিবেদক:
সরকারের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে একাদশ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে তিনি একথা বলেন। করোনা মোকাবেলায় সরকারের সফলতার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা আরেকটু নিয়ন্ত্রণে এলেই স্কুল খোলা হবে। তাছাড়া টিকা নিলেও সবার স্বার্থে মাস্ক পরতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বাস করি সততা নিয়ে কাজ করলে, আর সেই কাজের সুফল জনগণ পেলে সেটাই তৃপ্তি। কেউ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে অবশ্যই দেশের উন্নতি করা যায়। আমরা সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। যার সুফল এ দেশের মানুষ পাবে।
প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের পর আমরা জনগণের ভোটে বারবার নির্বাচিত হয়েছি। জনগণের জন্য কাজ করছি। টানা সরকার গঠন করার কারণে উন্নয়ন কাজগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। জনগণ ভোট দিয়েছে। সেই ভোটের মর্যাদা রক্ষা করা, তাদের সেবা করা আমাদের কাজ। উন্নয়ন করার ইচ্ছা থাকলে তা করা যায়। আমরা তা প্রমাণ করেছি। তিনি বলেন, দেশের মানুষের উন্নয়ন হচ্ছে। কল্যাণ হচ্ছে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ মানুষের আস্থা বিশ্বাস অর্জন করছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে মানুষ এখন আন্তরিকভাবে ভোট দিচ্ছে। পঁচাত্তর পরবর্তী শাসনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় নির্বাচনে কি জনগণের আদৌ ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। মিলিটারি শাসকেরা যেটা ঠিক করে দিতো সেটাই হতো। না হলে পরিবর্তন করা হতো। রেজাল্টও পরিবর্তন হয়েছে। অনেককে কিন্তু পদত্যাগ করতেও হয়েছে। আমরা আন্দোলন করেছি। জনগণ আন্দোলন করেছে। যার কারণে তাদের পদত্যাগ করতে হয়েছে। পরবর্তীরা এতিমের অর্থ আত্মসাতের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্রপতির পুরো ভাষণটি পড়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, এতে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে তা জানা যাবে। জানা যাবে সরকার ভবিষ্যতে কী করতে চায় সেটাও।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে পদার্পণ করেছি। রজতজয়ন্তীতে ক্ষমতায় ছিলাম। সৌভাগ্য যে সুবর্ণজয়ন্তীতেও ক্ষমতায় থাকতে পেরেছি। সুবর্ণজয়ন্তী পালনে আমাদের অনেক আকাঙ্খা ছিল বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করবো। অনেক অনুষ্ঠান আমাদের চিন্তায় আছে। করোনার দ্বিতীয় ওয়েব দেখা দিয়েছে। আমাদের এজন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। আমরা সব কর্মসূচি নিয়েছি। তবে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবো। মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে লক্ষ রেখে আমরা কর্মসূচি পালন করবো। কারণ, আমাদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষকে সুরক্ষায় রাখা। বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিএনপির কাছ থেকে অনেক সমালোচনা শুনি। কিন্তু আমার মনে হয় তারা আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখেন না। অবশ্য চেহারা নিশ্চয়ই দেখেন। মেকআপের জন্য তো দেখতেই হয়। কিন্তু নিজেদের কাজটিকে দেখেন না। বিএনপির ওপর মানুষের আস্থা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাদের গায়ে দুর্নীতির ছাপ, যারা ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ পাঁচ-পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে, দুর্নীতির দায়ে যাদের কারাবরণ, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারির মামলা ও গ্রেনেড হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, এরা যখন কোনও দলের নেতৃত্বে থাকে, সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক আসামি সেই দল চালায়, তারা জনগণের কাজ করবে কীভাবে? বিএনপির তো এখন সেই দশা। তাদের নেতৃত্বের অভাব। কাজেই যতই বক্তৃতা দিক আর যতই কথা বলুক, সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক আসামিরা যখন একটি দলের নেতা, তাদের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস থাকে না। সেই আস্থা-বিশ্বাস মানুষের নেই। আস্থার জায়গাটা সরে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুজিবের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না। কেউ ঠিকানাবিহীন থাকবে না। এটাই সরকারের লক্ষ্য। আমরা গৃহহীনদের গৃহ দেওয়ার জন্য গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। পাশাপাশি ব্যারাক নির্মাণ করে মানুষের থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের জন্য ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। মুজিববর্ষকে সামনে রেখে ব্যারাক হাউজে সাড়ে তিন হাজার, আর ছোট ছোট ঘর করে প্রায় ৬৬ হাজার মানুষকে পুনর্বাসন করেছি। আরও এক লাখ মানুষের ঘর তৈরির কাজ চলমান আছে। একটি মানুষও গৃহহারা থাকবে না। এটাই আমাদের লক্ষ্য। সারা দেশে ৫৬০টি মসজিদ তৈরির কার্যক্রম চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মসজিদগুলোতে ইসলামিক সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি ইমামদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। ইসলাম ধর্মটি সঠিকভাবে মানুষ জানবে এবং তার চর্চা করবে সেদিকে লক্ষ রেখে এই মসজিদগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে।
করোনা আরেকটু নিয়ন্ত্রণে এলেই স্কুল খোলা হবে: প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা প্রসঙ্গে বলেন, পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে অনলাইনে পাঠ চলমান রয়েছে। আমরা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছি। তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। শতভাগ পাসের ব্যবস্থা হয়েছে। এতে স্কুল-কলেজে যেতে না পারার যে দুঃখ ছিল তা দূর হবে। করোনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। আরেকটু নিয়ন্ত্রণে এলেই আমরা স্কুল কলেজ সব খুলে দেবো। তখন ছেলেমেয়েরা আরও সুন্দরভাবে পড়াশোনা করতে পারবে।
করোনাভাইরাস কেনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে যখন গবেষণা শুরু হয়েছিল, কারা কারা এটা করছে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। ভ্যাকসিন কেনার ব্যবস্থা নিয়ে রাখা হয়েছে। এজন্য আমরা অগ্রিম টাকা দিয়ে দিয়েছি। এক হাজার কোটি টাকা আমরা ভ্যাকসিনের জন্য আগাম দিয়েছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখনই স্বীকৃতি দিয়েছি আমরা সঙ্গে সঙ্গে কিনেছি। আমরা জানি এটা নিয়ে অনেক কথা ও সমালোচনা হয়। অনেক ব্যঙ্গ করা হয়। উত্তরটা ভ্যাকসিন আসার পরে বোধহয় ভ্যাকসিন নিজেই দিয়ে দিয়েছে। যারা সমালোচনা করেছে তাদের মুখেই থাপ্পড় পড়েছে। আমাদের কিছু করা লাগেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনেছি। ভারত ২০ লাখ ডোজ উপহার হিসেবে দিয়েছে। কেনা ভ্যাকসিনের ৫০ লাখ ইতোমধ্যে এসে গেছে। ইতোমধ্যে প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় ভ্যাকসিন পৌঁছে গেছে। প্রাথমিকভাবে দেওয়াও শুরু হয়েছে। দেওয়ার পর কী রিঅ্যাকশন- খুব খারাপ রিঅ্যাকশন শোনা যায়নি। চার-পাঁচজনের হাতে একটু ব্যথা হয়েছে। হালকা জ্বর হয়েছে। আগামী ৬ বা ৮ তারিখ থেকে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হবে। কারা চায় তারা রেজিস্ট্রেশন করবে। যারা চাইবেন তাদের করোনার টিকা দেওয়া হবে। কে কে চায় তা বলতে হবে। ভ্যাকসিন যারা নেবেন তাদেরও মাস্ক পরে চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ব থেকে করোনাভাইরাস না যাবে ততদিনই এটা মেনে চলতে হবে। তাছাড়া অ্যান্টিবডি টেস্টের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেটাও করা হচ্ছে।
বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় আমরা বিশ্ব থেকে সাধুবাদ শুনেছি। কিন্তু কেবল শুনি না নিজের দেশের ভেতরে। গুজব রচনা করে, মিথ্যা কথা বলে, অসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা বিএনপির জন্মগত চরিত্র। তাদের কথা তারা বলে যাবে। আমাদের কাজ আমরা করে জনগণকে সেবা দিয়ে যাবো। কথা তো তাদের বলতে দিতে হবে। না বললে পেটের মধ্যে গুড় গুড় করবে। আর বলে ফেললে বাতাসে উড়ে যাবে।
নৌকায় বসে যাতে নৌকা ফুটো না করে: পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে এত কথা। অথচ এরকম একটি কাজ নিজেদের অর্থায়নে করলাম। তার প্রশংসা তো করতেই পারলো না। উল্টো বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলো জোড়া তালি দিয়ে পদ্মা সেতু করা হয়েছে। কেউ এতে উঠবেন না। তাহলে নদীটা পার হবে কীভাবে? সেতু দিয়ে পার না হলে তো নৌকায়ই যেতে হবে। উপায় তো নেই। নৌকায় চড়তে হবে। আমাদের নৌকা অনেক বড়, কোনও অসুবিধা নেই। নৌকায় সবাইকে নেবো। তবে বেছে নেবো, নৌকায় বসে নৌকা যাতে ফুটো না করে।’
আমি বড় একটি কারাগারে বন্দি: করোনা সংক্রমণকালে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সুযোগকে বাইরে বের হওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনাকালে সংসদ অধিবেশনের সময়গুলো ভালো কেটেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো বড় একটি কারাগারে বন্দি আছি। এজন্য সংসদ অধিবেশনে আমার সময় ভাল কাটে। সংসদে এসে সবার সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আরো বলেন, এই অধিবেশনে এতো অল্প সময়ের মধ্যে ১৩২ জন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য দিয়েছেন। কাজেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন। করোনাকালে অধিবেশন পরিচালনার জন্য স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান তিনি।