নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত নেপথ্য মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে একটি ‘তদন্ত কমিশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত এক বছরেও কার্যকর হয়নি। আইন মন্ত্রনালয় সুত্র জানায় করোনা মহামারির কারনে এই উদ্যোগ থেমে গেছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা।
গত বছর জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারী ও কুশীলবদের ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জোরালো হয়েছিল। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়কদের খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার দাবি এসেছিল ১৪ দলের পক্ষ থেকেও। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ২০২০ এর ১৯ আগস্ট ১৪ দলের ভার্চুয়াল সভায় এই দাবি উত্থাপন করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে মত দেন। সভাপতির বক্তব্যে আমির হোসেন আমু বলেছিলেন, এই সভা থেকে অনেকেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নায়কদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন। কমিশন গঠন করার মধ্য দিয়ে তদন্ত করা হোক যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল, আর কারা নেপথ্যে নায়ক ছিল। যারা নেপথ্যে নায়ক হিসেবে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছে, এজন্য একটা তদন্ত কমিশন গঠন হওয়া উচিত।
এদাবি ওঠার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত নেপথ্য মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে একটি ‘তদন্ত কমিশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে। কমিটির ফরমেট কি হবে, কার্যপরিধি কি হবে সবই ঠিক করা হয়েছে। কিন্তুু করোনার কারনে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হয়নি।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এটা দিনের আলোর মত সত্য যে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান যে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তার সাক্ষ্য-প্রমাণ কমিশনের মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে ইনশাল্লাহ। ১২ আগস্ট গুলশানে নিজ বাস ভবনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। আইনমন্ত্রী বলেন, যখন এ মামলার তদন্ত হয় তখন জিয়াউর রহমানকে আসামি করা হয়নি।কারণ তখন তিনি মৃত। মৃত ব্যক্তিকে আসামি করার সুযোগ নাই। বাংলাদেশের আইনে মরণোত্তর সাজা দেয়ার কোনো বিধান নাই। আইনের বাইরে গিয়ে শুধু তামাশা করার জন্য একজনকে সাজা দেয়া যায় না। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে যে জিয়াউর রহমান জড়িত সেটার সাক্ষ্য প্রমাণ, ইনশাল্লাহ এই কমিশনের (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কুশিলবদের খুঁজতে কমিশন গঠিত হবে) মাধ্যমে জন সম্মুখে প্রকাশ করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে এনে আদালতের রায় কার্যকর করার ব্যাপারে শেখ হাসিনার সরকার বদ্ধ পরিকর বলে আইনমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, শুধু তার সরকার নয় আওয়ামী লীগ যতদিন বাংলাদেশে থাকবে, বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের একজন বেঁচে থাকলেও হত্যাকারীদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের রায় কার্যকর করা হবে। খুনিদেরকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ চলমান প্রক্রিয়ার ব্যাপারে বিশদ কিছু বলতে গেলে এ প্রক্রিয়ার কিছু ব্যাঘাত হবে। তবে এই ব্যাপারে সরকারের কোন শিথিলতা নেই। খুনিদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা সরকার চালিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিশন গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার স্বাক্ষ্য প্রমাণ ও আলাপ আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন শুধু তারাই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়। এর পিছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে এবং সেই ষড়যন্ত্রকারী কারা তাদেরকে অন্ততপক্ষে চিহ্নিত করে দেশের মানুষের কাছে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। মন্ত্রী বলেন, এই ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া কি হবে তা নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলাপ আলোচনা করে একটি কমিশন গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিগত ৮ মার্চ, ২০২০ থেকে করোনার মহামারী শুরু হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই কমিশনের রূপরেখা কি হবে, কমিশনের কার্যাবলি কি হবে, কমিশন কাদের দ্বারা গঠিত হবে তা দেশবাসী জানতে পাবেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পলাতক খুনি মুসলেম উদ্দিন ভারতে পলাতক রয়েছে এমন প্রশ্নের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা তা যাচাই বাচাই করে দেখেছি। এখন পর্য ন্ত তার কোন সত্যতা আমরা পাইনি।
আইনমন্ত্রী বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সাবেক সেনাসদস্যদের বিচার হলেও এর পেছনের রাজনীতি এবং ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। সেজন্য সরকার কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন আনিসুল হক।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কমিশনকে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ রাখতে চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্য পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা চলছিল। তবে করোনা পরিস্থিতি আরও বাড়তে থাকায় বার বার লকডাউনের কারনে তদন্ত কমিশন গঠনের উদ্যোগ থেমে গেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কয়েকজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আদালতের রায়ে হত্যাকাণ্ডের পেছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ ছিল। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত উঠে আসেনি। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের বিলম্ব হলেও বিচার হয়েছে। তবে ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্রকারী বা কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। তাদেরও বিচার করার দাবি দীর্ঘদিনের। বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচার বন্ধ করে রাখা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১০ সালে কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যাদের শাস্তি হয়েছে, তারা মূলত আত্মস্বীকৃত খুনি। তবে এ ঘটনার ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে তদন্ত কিংবা বিচার হয়নি। হত্যার নেপথ্যে জড়িতদের খুঁজে বের করা জরুরি বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, সামরিক বাহিনীর বিপথগামী কিছু অফিসার ও সৈনিকই শুধু এই ন্যক্কারজনক হত্যাকা ঘটায়নি। এর পেছনে অনেক বড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কাজ করেছে।
জানা গেছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পর পরই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় বিভিন্ন দেশে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার পর সে দেশে সাত দিনের মধ্যে ওয়ারেন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী হত্যার পর কাপুর কমিশন, দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর থ্যাকার কমিশন ও রাজীব গান্ধী হত্যার পরও জৈন কমিশন গঠন করে সরকার।
এখনও অধরা বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনি : দশ বছর পর গত বছর একজনকে পেয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী ফাঁসিতে ঝুলানো হলেও এখনও অধরা বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি। তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী। এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরীর কানাডায় অবস্থানের খবর সবার জানা। তাদের ফেরানোর চেষ্টা চললেও তার কোনো অগ্রগতি নেই। মোসলেম উদ্দিন গত বছর ভারতে ধরা পড়েছেন বলে সেদেশের গণমাধ্যমে খবর বের হলেও তার সত্যতা নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। রশীদ ও ডালিম যে কোথায় আছেন, তার তালাশ এখনও পায়নি দেশের গোয়েন্দারা। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বরাবরের মতোই বলছে, পলাতক খুনিদের আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এনসিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টাপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থ্য গ্রহণের পাশাপাশি খুনিদের আশ্রয়স্থল সম্ভব্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।