প্রতিটি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে কাজ করছে মন্ত্রণালয়

রফিকুল ইসলাম সবুজ
বাংলাদেশ রেলওয়েকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। রেলকে আধুনিক ও যুগোপযোগী যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সারাদেশে ট্রেন যোগাযোগে ৫ লাখ ৫৩,৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ২০৪৫ সাল পর্যন্ত ৬টি ধাপে এই নতুন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে রেলওয়ে।

সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যুগান্তকারী এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০৪৫ সালের মধ্যেই ভোলা ছাড়া দেশের সব জেলায় ট্রেনে যাতায়ত সম্ভব হবে। তবে ঐসময়ে যদি ব্রীজ বা সাগরের নীচ দিয়ে টানেল করা সম্ভব হয় তাহলে ভোলা জেলাকেও ট্রেন নেটওয়ার্কের আওতায় আনা যাবে। কর্মকর্তারা জানান চাহিদার তুলনায় কোচ ও লোকোমোটিভ এর স্বল্পতা রয়েছে এবং গেজ ইউনিফিকেশন না থাকায় দেশের দু’অঞ্চলের মধ্যে সরাসরি ট্রেন পরিচালনা করতে না পারা রেলওয়ের অন্যতম সমস্যা।

মন্ত্রনালয় সুত্র জানায়, বর্তমানে দেশের ৪৪টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। ২০২২ সাল নাগাদ দেশের আরো ৯টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। এই জেলাগুলো হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নড়াইল, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বান্দরবান ও কক্সবাজার। আর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যেই পর্যায়ক্রমে মাগুরা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও মানিকগঞ্জ এই ৬টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। বাকি অন্য জেলাগুলোও নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে ২০৪৫ সালের মধ্যে। তবে ঐসময়ে শুধুমাত্র রেলযোগাযোগ থেকে বাদ থাকবে দ্বীপ জেলা ভোলা। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর লক্ষ্মীপুর, শেরপুর, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি-এ ৪টি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। পরবর্তীতে অবশিষ্ট ভোলা জেলাকেও রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
রেলপথ মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রেলওয়ের বিদ্যমান মাস্টারপ্ল্যান সম্প্রতি হালনাগাদ করা হয়েছে, যার মেয়াদ ধরা হয়েছে ৩০ বছর (২০১৬-২০৪৫)। সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে রেলওয়ে মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুুক্ত প্রকল্প পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ধাপে ৮৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে প্রায় ১,৪৭৮৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে। দ্বিতীয় ধাপে ২০২১ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৬৭টি প্রকল্পে ১,১৯,৬৮০ কোটি টাকা, তৃতীয় ধাপে ২০২৬ সাল থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩৭টি প্রকল্পে ৯৪,১৬১ কোটি টাকা, চতুর্থ ধাপে ২০৩১ সাল থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২৩টি প্রকল্পে ৯৬, ৮৮৫ কোটি টাকা, ৫ম ধাপে ২০৩৬ সাল থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ১৪টি প্রকল্পে ৮২,৬৪৯ কোটি টাকা এবং ৬ষ্ট বা শেষ ধাপে ২০৪০ সাল থেকে ২০৪৫ সাল পর্যন্ত ৬ টি প্রকল্পে ব্যয় করা হবে ১২,৪৫৪ কোটি টাকা।

সংস্লিষ্ট সুত্র জানায়, ইতিমধ্যে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ, সারাদেশে ডুয়েল গেজ রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ, বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে রেল সেতু নির্মাণ, যমুনা নদীর উপর বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি এলাকায় আরেকটি রেল সেতু নির্মাণ এবং পদ্মা নদীর উপর আরও একটি রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়। রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মহাপরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে সারাদেশে ট্রেনে যাত্রীসেবা যেমন বাড়বে ও তেমনি পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ৩০ বছর মেয়াদী রেলের এই মহাপরিকল্পনা যুগান্তকারী উন্নয়নের পদক্ষেপ। বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী নেয়া প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডোরকে সম্পুর্নভাবে ডাবল লাইনে উন্নীত করা, ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, ৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা থেকে মংলা পোর্ট পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার নতুন ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ, ২ হাজার ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ- টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ, ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মায়ানমারের নিকট গুনদুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেল লাইনও নির্মিত হচ্ছে এই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী। এছাড়া ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পীড ট্রেনও চালু করা হবে। আখাউড়া-সিলেটের মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকায় ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, রাজধানীর চারপাশে এলিভেটেড সার্কুলার রেলপথ নির্মাণ, জয়দেবপুর থেকে বঙ্গন্ধু সেতু পর্যন্ত ডাবল লাইন রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হবে।

রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, মহাপরিকল্পনা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী প্রতিটি জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। রেলখাতে সেবার মান বাড়িয়ে যুগপোযোগী করে মানুষের চাহিদার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, সারাবিশ্বে রেলের উন্নয়ন খুব দ্রুত হচ্ছে। আমরাও পিছিয়ে থাকবো না। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর ১০টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে রেলের দু’টি প্রকল্প রয়েছে। রেল এখন ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখাতে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ট্রান্স এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *