সংসদ প্রতিবেদক:
চিকিৎসক, চিকিৎসা সেবা ও বেসরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা করেছেন জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। বুধবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তিনটি বিল পাসের সময় তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনায় মুখর হন। সরকারি চাকরিতে থাকা চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস এবং রাজনীতি করারও তীব্র সামলোচনা করেন তারা। চিকিৎসার বিল দিতে না পারায় বেসরকরি হাসপাতালগুলো রোগী আটকে রাখে বলেও অভিযোগ করেন সংসদ সদস্যরা। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাব দেন। এসময় সরকারি দলের কয়েকজন সদস্যকে পাশ থেকে মন্ত্রীকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতে দেখা যায়।
বুধবার সংসদে ‘মেডিকেল ডিগ্রিস (রিপিল) বিল-২০২১’ এবং ‘মেডিকেল কলেজ (গভর্নিং বডিস) (রিপিল) বিল-২০২১’ পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিরোধী দলের সদস্যরা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিএনপি করে গিয়েছিল ড্যাব, আওয়ামী লীগ এসে করেছে স্বাচিপ। সেক্ষেত্রে আমরা কী কারণে বসে থাকছি? এই আইনের মধ্যে যদি উনি আনতেন, যে ডাক্তাররা এবং বৈজ্ঞানিকরা রাজনীতি করতে পারবে না, তাহলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু সেটা আনা হয় নাই। ডাক্তাররা যদি এই দেশে রাজনীতি করে, তাহলে আমরা কি করব? আমাদের কাজটা কী? উনারা চলে আসুক রাজনীতি করতে। যারা ভালো ছাত্র তারা ডাক্তারি পড়ে, কিন্তু তারা যদি রাজনীতি করে তাহলে আমরা সেবা বঞ্চিত হচ্ছি।
বিএনপির মোশারফ হোসেন বলেন, চিকিৎসকরা রাজনীতি করছেন। আমরা রাজনীতি করি রাজনীতিবিদের জায়গায় থাকব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার জায়গায় থাকবে। ডাক্তাররা ডাক্তারদের জায়গায় থাকবে। সেই জায়গাগুলোকে রিপেয়ার করা দরকার। বেসরকারি হাসপাতালগুলো- তারা কিছু যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে টাকা রোজগারের একটি পথ খুলে নিয়েছে, সেখানে মানুষগুলো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের লোক, জজ বা পুলিশ ক্যাডারের লোক তারাতো চাকরি করে প্রাইভেট কোনো বিষয়ে কনসালটেন্সি তারা করতে পারেন ন না। ডাক্তার সাহেবরা কেন বিসিএস অফিসার হয়ে ডিউটির পর প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে? সেক্ষেত্রে তার যে মূল কাজ সেটা ঠিক থাকে না। এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। মন্ত্রীকে বলব, যদি উপকার করতে চান, তাহলে ডাক্তার সাহেবদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসটা আপনারা দয়া করে বন্ধ করার চেষ্টা করেন। জনগণের পয়সা দিয়ে তাদের বেতন দেবেন, তারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন, এটা আমরা করতে পারি না। ভর্তির জন্য বেসরবারি মেডিকেল কলেজ কয়েক লাখ টাকা নেয় আনঅফিশিয়ালি। অন্যায়ভাবে এত টাকা নিচ্ছে। মুজিবুল হক এই বিল আনার চেয়ে ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে’ মন্তব্য করে বলেন, টিকা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু করতে পারেনি। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে একটি রোডম্যাপ হয়েছে। সবক্ষেত্রে কেন প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে? একটি কমিটি করে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার জন্য খরচের হার নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি তোলেন এই সংসদ সদস্য।
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে বেহাল দশা, দেশের পঞ্চশ বছর অতিক্রম করেছি, আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারিনি। যারা আজকে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত, তারাই আজকে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসা করছে। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এতগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, এইগুলো মানসম্মত? আজকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে যারা শিক্ষা অর্জন করছে, তারা কয়জন বিসিএসে টিকছে? ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, এই ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন?
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘দেশ যায় কোন দিকে, মানুষের সমস্যা যায় কোন দিকে, মানুষ কোন বিষয় নিয়ে সাফার করছে, আর আমরা আলোচনা করছি কী? অদ্ভুত লাগে! করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে কতগুলো পরিবার পঙ্গু হয়ে গেছে সেই খবর কী আমাদের কাছে আছে? করোনাকালে হাতে গোনা কিছু রিপোর্ট আসছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, করোনায় সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। অনেকে প্রাণে হয়ত বেঁচে গেছে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। জমানো টাকা শেষ হওয়া থেকে শুরু করে বিরাট ঋণের জালে আটকা পড়েছে বহু মানুষ। করোনার আগে যেখানে মধ্যবিত্ত ছিল ৭০ শতাংশ, সেখানে মধ্যবিত্ত নেমে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। দরিদ্র মানুষ যেখানে ছিল ২০ শতাংশ, সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। করোনাকাল বলে হয়ত এ ব্যাপারে মিডিয়ার কিছুটা মনযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি মেডিকেলে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ইতিহাস কিন্তু নতুন কিছু নয়।’
জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। টেকনোলজিস্টের ব্যাপক সংকট। ২০২০ সালের পরীক্ষার ফলাফল এখনও দেওয়া হয়নি। অনেক মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক এয়ারপোর্টে পিসিআর ল্যাব দিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পরও প্রবাসীদের ঘেরাও করতে হয়েছে।
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা পে স্ট্রাকচার করতে হবে। তাহলে তাদের বেসরকারি প্র্যাকটিস বন্ধ করা যাবে। অথবা সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করতে হবে। ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে সেবা আদায় করা যাবে না। তাদের মোটিভেট করতে হবে।
জবাব দিতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা দেশের প্রতিটি জেলায় মেডিকেল কলেজ হবে। সেটা পর্যায়ক্রমে হবে। সে অনুযায়ী ৩৮টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে সব জেলায় হয়ে হবে। তিনি বলেন, ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। স্বাচিপ, বিএমএ রয়েছে। রাজনীতিতো সকলেই করতে পারে। প্রকৌশলী, আইনজীবীরা রাজনীতি করতে পারে। সে অনুযায়ী চিকিৎসকরা অ্যাসোসিয়েশন করলে, তাতে কোনো দোষ বা অন্যায় দেখি না। তারাতো সেবা দিচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনার সেবা দিয়েছে। সেখানকার চিকিৎসা ফি নির্ধারণে আমরা বৈঠক করছি। আশা করি সেটার সমাধান হবে। বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবেন। আর বিমানবন্দর জায়গা দেবে। আমরা শুধু কারিগরি সহযোগিতা দেব। আমরা শুনেছি দুই একদিনের মধ্যে বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হবে। স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি হয়েছে দাবি করে জাহিদ মালেক বলেন, করোনার সময় কেউ বাইরে যেতে পারেননি। সবাই দেশেই ছিলেন। কোভিড, নন-কোভিড সব চিকিৎসা দেশে হয়েছে। এখান থেকে বোঝা যায় হাসপাতালের অবস্থা ভালো।
বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে আমরা কী করেছি স্বাস্থ্যখাতে আর আপনারা কী করেছেন এ বিষয়টি একটু তুলে ধরতে চাই জনগণের সামনে। আমরা জানি আপনারা কী বলতে পারেন। তাই আজকে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। সারাদিন লাগবে। কমিউনিটি ক্লিনিক ১৪ হাজার ছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, যেখানে ৩০ রকমের ওষুধ ফ্রি দেওয়া হত। স্বাস্থ্য সেবা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। আপনারা ক্ষমতায় এসে ওটাকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এটা হলো স্বাস্থ্যসেবায় আপনাদের ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, আপনাদের সময় কী হয়েছে আমরা জানি না। সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা এ সময় টেবিল চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন’।