জিয়ার লাশ নিয়ে এবার সংসদে তুমুল বিতর্ক

সংসদ প্রতিবেদক:
সাত কার্যদিবসে নয়টি বিল পাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশন। বৃহস্পতিবার দুপুরে অধিবেশন সমাপ্তির বিষয়ে রাষ্ট্রপতির আদেশ পড়ে শুনান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। গত ১ সেপ্টেম্বর অধিবেশন শুরু হয়েছিল। অধিবেশনের সমাপনী দিনে ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যানের সমাধিতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সমারিক শাসক জিয়াউর রহমানের লাশ থাকা না থাকা নিয়ে সংসদে বিএনপি এমপিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এমপিদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। ‘বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস বিল’ এর সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনার সময় জিয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন তারা।
বিএনপির সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন প্রথমে বিষয়টি উত্থাপন করে সরকার দলীয় সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেন, জিয়াউর রহমানের লাশ সেখানে (চন্দ্রিমা উদ্যান) আছে কি নেই, সেটা বড় বিষয় নয়। সেখানে যে লাশ নেই, তা আপনারা কীভাবে জানলেন? এতবছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। এটা নিয়ে আগে কথা বলেন নেই কেন? এখন কেন বলছেন?” তার বক্তব্যের পর বিএনপি ও জাতীয় পার্টির এমপিরা বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য দেন। পরে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ জিয়ার লাশ থাকার বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, সংসদ ভবন নিয়ে লুই কানের যে নকশা, সেখানে কোথায় রয়েছে যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ দাফন করতে হবে? সেখানে লাশ আছে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেগম জিয়া স্বামী মনে করে কাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান? তারই উচিত এই প্রশ্ন করা, উনার স্বামীর লাশ সেখানে আছে কিনা? বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে তারই নির্ণয় করা উচিত। আপনারা নিরপেক্ষ একটা কমিটি করেন। সরকার সহযোগিতা করবে।
বিএনপি হারুনুর রশীদ বলেন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তার বক্তব্যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ১৯৭৯ সালে সংসদ ছিল। সেখানে আওয়ামী লীগও ছিল। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে যে জানাজা হয়েছিল, তাতে সংসদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। শোক প্রস্তাবের উপর সংসদে দীর্ঘ আলোচনায় তারা অংশ নিয়েছিলেন। সেগুলো প্রসিডিংসের মধ্যে রয়েছে। আমার কথায় যদি কোনো অপ্রাসঙ্গিক বিষয় থাকে, তা এক্সপাঞ্জ করুন। তিনি বলেন, কারো যদি অপমৃত্যু হয়। তাহলে তার ময়নাতদন্ত লাগে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। সামরিক আদালতে বিচারও হয়েছে। এটা অসত্য কিছু নয়। আজকে জেনারেল এরশাদ বেঁচে থাকলে তিনি লজ্জা পেতেন। লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকতেন।
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, আরকাইভস যদি করতে হয়, তাহলে স্বীকার করতে হবে জিয়াউর রহমান ছিলেন রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ছিলেন বীর উত্তম, এটা স্বীকার করেতে হবে। তিনি বলেন, ইতিহাস সবসময় জয়ীদের হাতে লেখা হয় বলে। তাই আমাদের মত দেশে প্রকৃত ইতিহাস জানতে শতবছর লাগে। যতদিন পর্যন্ত দলীয় চশমায় ইতিহাস লেখা হয়, তাতে আইন পাস করে কোনো লাভ হবে না। আজকে ৪০ বছর পরে কেন জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে এই বিতর্ক। সরকারের ব্যর্থতা, ভোট চুরি, গণতন্ত্রহীনতা, লুটপাট থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই বিতর্ক করা হচ্ছে। রুমিন ফারহানার বক্তব্যের শেষ দিকে সংসদে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সরকার দলীয় সদস্যরা হইচই করেন।
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ইতিহাস বিকৃতিতো বিএনপিও করে। তারা বলেন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। এ বিষয়ে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের নির্দশনা রয়েছে। আর জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে কখনোই বলতে শুনেনি, দেখিনি উনি নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন। তাদের প্রথমে ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করতে হবে। তারপর আওয়ামী লীগ যদি ইতিহাস বিকৃতি করে থাকে, সেটা বন্ধের আহ্বান বিএনপি জানাতে পারে।
আইন প্রনয়ণ কার্যাবলী শেষে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, সেখানে কোনো লাশ নেই তা ৪০ বছর আগেই প্রমাণিত। একটি বাক্স রয়েছে। ওই বাক্স সরিয়ে ফেলার দাবি তুলে শেখ সেলিম বলেন, লাশ থাকলে তার স্ত্রী সন্তানকে দেখানো হয়নি কেন? তখন ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি লাশ থাকার প্রমাণ দিতে পারেনি। যদি লাশ থেকে থাকে, আগামী এক মাসের মধ্যে প্রমাণ দিতে হবে। ভবিষ্যতে সংসদে লাশ নিয়ে কোনো কথা যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে স্পিকারকে অনুরোধ করেন শেখ সেলিম। তিনি বলেন, আজ ৪০ বছর পর লাশ নিয়ে লাফালাফি করা হচ্ছে। সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমানের লাশ রয়েছে বিএনপির এমপিরা তা সংসদে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেখানে যে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই সেটা ৪০ বছর আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর তার লাশ পরিবারের কেউ দেখেননি। খালেদা জিয়া দেখেননি। তারেক জিয়া লাশ দেখার জন্য কান্নাকাটিও করেছিলেন। শাহ আজিজ একটি চালাকি করেছিলেন। ‘লাশ পাওয়া যাক না যাক, একটা বাক্স পাঠিয়ে দাও’। সেই বাক্স পাঠানো হয়েছিল। জনমনে সন্দেহ ছিল কিসের জানাজা করছি। শুধু বাক্স? নাকি ওখানে জিয়াউর রহমান আছে?
সেই সময়ের এক অধিবেশনের কথা স্মরণ করে সেলিম বলেন, ২০ জুন ১৯৮১ সালে আমি সংসদের নতুন সদস্য। জিয়াউর রহমান তখন মারা গেছেন। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। সংসদে আমি সরকারের কাছে এটা জানতে চেয়েছিলাম। এটা প্রসিডিংসে আছে। আমি সেদিন বলেছিলাম, আপনারা প্রমাণ করেন। ওই বাক্সে কোনো লাশ আছে কি না। জনমনে সন্দেহের কথা সেদিন সংসদে বলেছিলাম। আমি দুই দিনের মধ্যে লাশের ছবি ছাপিয়ে জনমনের সন্দেহ দূর করতে বলেছিলাম। আর না পারলে জনমনের সন্দেহ-ই প্রমাণিত হবে। আজ ৪০ বছরেও একখানা ছবি দেখাতে পারেননি। প্রমাণই করতে পারেননি। ওখানে যে বাক্সটা আছে তা সরিয়ে লুইকানের নকশা বাস্তবায়ন করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *