হাবীব রহমান (সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক সময়ের আলো।)
পঁচাত্তর বছর বয়সে এসে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটাই তৃপ্ত। তার রক্তে থাকা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন অনেকদূর এগিয়েছে। তিনি জাতিকে শুধু স্বপ্নই দেখাননি; তা বাস্তবায়নও করেছেন। নতুন এক আশা জাগিয়েছিলেন মানুষের মনে। সেই আশার নাম ‘রূপকল্প-২০২১’। এই রূপকল্পের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন কমিটি বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সে সময় জাতির পিতার জন্মদিন স্মরণে এক দলীয় কর্মসূচিতে নিজের তৃপ্তির কথা জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিছিয়ে পড়া দেশবাসীকে শেখ হাসিনা দেখিয়েছিলেন এক ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন; যেখানে থাকবে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি। ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছেন।
স্বাধীনতার চার দশক পর, পলাতক পাঁচ খুনি ছাড়া বঙ্গবন্ধুর বাকি খুনিদের বিচারের রায় কার্যকরে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে থেকেও দৃঢ়চেতা মনোভাবে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করছেন। এক সময় পুরো দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠীকে শক্ত হাতে দমন করেছেন। শেখ হাসিনা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা নারী সরকারপ্রধান। টানা ৪০ বছর ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতাকে তিনি শুধু রক্ষাই করেননি, আরও সুসংহত করেছেন। বাংলাদেশকে করেছেন বিশ্বময়। বিশ্ব নেতারা এখন শেখ হাসিনার কাছে উন্নয়নের গল্প শুনতে চান।
সফল সরকারপ্রধান হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তা, শান্তিচুক্তি, সমুদ্র বিজয়, নারীর ক্ষমতায়ন, মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো অবকাঠামোগত বিস্ময়কর ও অভাবনীয় সব উন্নয়নের ইতিহাসে অত্যুজ্জ্বলভাবে লেখা থাকবে শেখ হাসিনার নাম। তিনি চলমান করোনা মহামারি মোকাবিলা করছেন দক্ষ নেতৃত্বে।
উন্নয়ন অভিযাত্রায় ভিশনারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ‘রূপকল্প-২০৪১’। সে সময় বাংলাদেশ উন্নত দেশে পদার্পণ করবে। এই রূপকল্প বাস্তবায়িত হলে মাথাপিছু আয় হবে সাড়ে ১২ হাজার ডলারের বেশি। আর বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলাÑ যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা।
ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন শতবর্ষী ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’, যা ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ হিসেবে পরিচিত। ডেল্টা প্ল্যানে ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন। এই ছয়টি হলো ডেল্টা প্ল্যানের ছয় স্তম্ভ। দীর্ঘমেয়াদি এ ব্যবস্থাপনায় উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা, পার্বত্য অঞ্চল এবং নগর এলাকাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী বৈদেশিক নীতির সুফল হিসেবে ভারতীয় লোকসভায় ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি পাস হয়। ফলে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতায় ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ দুটি ঐতিহাসিক সমুদ্রসীমা মামলায় জয়লাভ করে। ফলে ভারতের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার জায়গা পায় বাংলাদেশ।
১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার পর যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু নির্মাণ করে, যা ছিল সেই সময় বিশে^র দীর্ঘতম সেতুর তালিকায় একাদশতম। ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় তার সরকার ২ কোটি বন্যাদুর্গত মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করে। তার নেতৃত্বাধীন সেই সরকারের আমলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তি, একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা এবং বিশ^কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ঘটে।
নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রপথিক বিবেচনা করা হয় শেখ হাসিনাকে। তিনি নিজেই বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নারীদের একজন। দেশের নারীদের মূলধারায় নিয়ে আসা এবং নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার অবদান সব সময়ের জন্য স্মরণীয়। তিনিই স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদে বৃহত্তর ওয়ার্ডে নারী প্রতিনিধি রাখার নিয়ম চালু করেন। নারীশিক্ষায় অবদানের জন্য ইউনেসকোর শান্তিবৃক্ষ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
নারীশিক্ষা ও নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রগতি অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘গে¬াবাল সামিট অব উইমেন’-এর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গে¬াবাল উইমেনস লিডারশিপ’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের সভায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি পুরস্কার ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জনের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আর প্রায়োগিক সামর্থ্যকে আরও বেগবান করেছেন তিনি। শিশু মৃত্যুর হার রোধ এবং নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার অসামান্য সাফল্য বিশ্ব গণমাধ্যমে উঠে এসেছে বারবার।
গ্রামীণ নারী, নারী উদ্যোক্তা, মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা, চাকরিতে নারীর অধিকার, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ইত্যাদি সেক্টরে ভিন্ন আঙিকে গ্রহণীয় ব্যবস্থা ও সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বাধীন সরকার শিশুর সুস্থ-সুন্দর মানসিক বিকাশের জন্য এবং মায়েদের শারীরিক সুরক্ষার জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটিকে চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস নির্ধারণ করেছে।
নারীর সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও ব্যবসায়ে সমান সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকার ২০১১ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি পাস করে। যেখানে নারীদের সম্পদের সমান অধিকার এবং ব্যবসায়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। পারিবারিক সহিংসতা (দমন এবং নিরাপত্তা) আইন ২০১০ পাস করা হয়। মানবপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১১ প্রণয়ন করা হয়। বাল্যবিয়ে রোধে বর্তমানে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর।
আততায়ীর হাতে মা-বাবা, ভাই-ভাবিসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হারিয়ে শেখ হাসিনা যেন শত্রুর আগুনের ছাই থেকে ওঠে আসা এক মানুষ- যিনি দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৮১ সালে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল গণতন্ত্রের ফিরে আসা, দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির ফিরে আসা; সে সঙ্গে অনির্বাচিতভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের বিদায়। দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও সাফল্যের পথ পেরিয়ে এখনও শেখ হাসিনার হাসি প্রাণবন্ত। তার হাসিতে হাসে দেশের কোটি বাঙালি। দুই চোখে তার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। যেখানে থাকবে না ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই ক্লান্তিহীন পথচলা তার।
সাদাসিধে এক জীবন
প্রধানমন্ত্রী হয়েও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সময় পেলে নিজ হাতে রান্না করেন, শিশুদের নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন। লেখালেখি করেন। সুযোগ পেলে ভ্যান-রিকশায়ও ওঠেন। গোপালগঞ্জে নিজ বাড়িতে গিয়ে একবার নাতি-নাতনি এবং ভাগনে ও ভাগনের বউকে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গ্রামীণ পরিবেশে গেলেই যেন তিনি শৈশবে ফিরে যান। নেত্রকোনায় বন্যাদুর্গতদের দেখতে গিয়ে গ্রামের সরু পথে রিকশার আরোহী হলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সেই রিকশায় চড়ার ছবি জনপ্রিয়তা পায় ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আরও বিস্ময় জাগায়, যখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও তিনি জড়িয়ে ধরে, স্নেহ করেন। বলেন, ‘তোমরা আমার সন্তানের মতো’। ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ের পর কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ার জনসভায় বৃদ্ধা করফুলা বেওয়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে কাছে আসতে পারছিলেন না। কিন্তু তার চেষ্টা নজর কাড়ে প্রধানমন্ত্রীর। কাছে টেনে নেন তাকে। করফুলা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি গীত রচনা করেন। ‘মাগো আমার কোন দ্যাশে ছিলা? তুমি মা জননী, জগৎ তরণী। আলো পাইলাম, তোমায় পাইলাম।’ শেখ হাসিনা জড়িয়ে ধরলেন করফুলাকে। এ রকম ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। প্রধানমন্ত্রী করোনাকালে বেশ কয়েকবার বলেছেন, করোনার সময় তাকে বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে। তিনি থাকতে চান সবসময় জনতার কাতারে। একেবারে সাধারণের চরম আপন হয়ে থাকতে চান প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান হয়েও দামি ব্র্যান্ডের কাপড় পরেন না, প্রসাধনও নেহাত সাধারণ, পাটের জুতা, ব্যাগ ব্যবহার করেন। কম দামের জামদানি শাড়ি পরেন নিয়মিত। উপহারের দামি শাড়ি দলের নারী কর্মীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। গণভবনের গাছের ফল-ফলাদিও দলের নেতাকর্মী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও শিশুদের সঙ্গে গণভবনের লনে খেলার জন্য কিছুটা সময় বের করেন শেখ হাসিনা। নিজের আপনজন ছাড়াও দূরের শিশুরাও এতে আসতে পারে। সাকিবকন্যা আলাইনাকে কোলে নিয়ে তার তৃপ্তির হাসির ছবিটি এখনও অনেকের মানসপটে তাজা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ততার মধ্যেও প্রায় নিয়মিতই রান্না করেন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, নাতি-নাতনিদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে মাছও কাটেন, পরিষ্কার করেন। তারপর পরম মমতায় রান্না করে পরিবেশন করেন। পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিনে রান্নার ছবি মুগ্ধ হয়ে দেখেছে সারা দেশ। ঘনিষ্ঠরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী দারুণ আলুভর্তা করেন, গরুর মাংস রান্না করেন, পরোটা বানান, এখনও প্রিয় আচার তৈরি করেন নিজ হাতে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েন। ফজরের নামাজ পড়ে দিন শুরু করেন। কখনও নামাজ কাজা করেন না। নামাজ সেরে গণভবনে হাঁটাহাঁটি করেন। নিজ হাতে চা বানিয়ে খান। সাতসকালে জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলো নিয়ে বসেন প্রতিদিন। প্রয়োজনীয় নোট নেন। তাৎক্ষণিক কিছু নির্দেশনাও সংশ্লিষ্টদের দেন। এভাবেই চলে সারা বছর।