স্কুল জীবন থেকেই সাহসী ও সংগ্রামী ছিলেন শেখ হাসিনা

রফিকুল ইসলাম সবুজ:
‘সামরিক শাসক আইয়ুব খান দেশে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিল। আমাদের সমাজপাঠ নামে একটি বইতে এসব পড়তে হতো। ক্লাস নাইনে সমাজপাঠ পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে শেখ হাসিনা মৌলিক গণতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করে অনেক কিছু লিখে দিয়েছিলেন। হাসিনা যে খুবই দৃঢ়চেতা ছিলেন এটা তারই প্রমাণ।’ কথা গুলো বলছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্ম দিন উপলক্ষে আলাপকালে নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, খাতায় এরকম লেখার কারণে স্কুল থেকে খবর পেয়ে তখন শেখ হাসিনার গৃহশিক্ষককে এসে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। আজিমপুর স্কুল (বর্তমানে আজিমপুর গভ: গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ) জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানান, ৬৪ সালে তাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল স্কুলে ধর্মঘট করানো ও পিকেটিং করার। ধর্মঘটের কথা ছাত্রীদের মধ্যে প্রচার ও পিকেটিং করার কারণে ঐসময়ে তাকে এবং শেখ হাসিনাকেসহ তাদের ১০জন সহপাঠীকে স্কুল কর্তৃপক্ষ শোকজ করেছিল। শেখ হাসিনা স্কুল জীবন থেকেই অনেক দুরন্ত, সাহসী ও সংগ্রামী ছিলেন জানিয়ে মিনু বলেন, কলেজে সাধারণ ছাত্রীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তাও অনেক বেশি ছিল। একারণে ১৯৬৬-৬৭ সালে বকশীবাজার গভ: ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেছা কলেজ) ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন ছাত্র ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী হলেও শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তার কারণে জয়ী হন। নিজে ১৯৬৫-৬৬ সালে কলেজ ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন জানিয়ে নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, শেখ হাসিনা মুলত কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি বলেন, তাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের জন্য ছাত্রদের সংগ্রামে মুখর। এই সংগ্রামই পরে ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে রূপ নেয়। তখন শেখ হাসিনাসহ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন।
ফেলে আসা ৭৪ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে দিশাহারা ও বহুধাবিভক্ত দলের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। শুরু হয় রাজনৈতিক প্রতিকূল স্রোতে তাঁর নৌকা বাওয়া। মৃত্যুশঙ্কা পায়ে ঠেলে, বহু ঝড়ঝাপটা সামলে, বিপৎসংকুল সমুদ্র পেরিয়ে বারবার নৌকাকে সফলতার সঙ্গে তীরে ভিড়িয়েছেন এই কাণ্ডারি। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন দলে পরম নির্ভরতার প্রতীক। শুধু দল নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও দেখিয়েছেন বহু চমকপ্রদ সাফল্য। অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মধুমতী নদীবিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম। সেখানেই শৈশব-কৈশোর কাটে। বাংলার মাটির নিবিড় সংস্পর্শে বেড়ে ওঠার কারণেই পরবর্তী সময়ে এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর যোগসূত্র তৈরি হয়। শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবনের শুরু টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকায় টিকাটুলীর নারী শিক্ষা মন্দিরে (শেরে বাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ) ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ওই কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্রসংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। কলেজজীবন শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬৮ সালে পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় শেখ হাসিনার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল সেনা সদস্য যখন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে, তখন শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা জার্মানিতে ছিলেন ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাসায়। মা-বাবাসহ স্বজনদের হারিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার এক অবর্ণনীয় দুঃসহ জীবন শুরু হয়। নানা দেশ ঘুরে তাঁদের আশ্রয় মেলে প্রতিবেশী দেশ ভারতে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে যায় আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি হয়ে পড়ে বিভক্ত। এই বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই বছরই তিনি তৎকালীন শাসকদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন দলের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁকে দলের অভ্যন্তরেও নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়।নিজের বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার বলে শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে দলের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আবারও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। মাঝে একবার বিরতি দিয়ে ২০০৯ সালে আবারও প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। তখন থেকে এখন পর্যন্ত টানা তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। এ দেশে এখন পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এই পদে রয়েছেন। তবে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার এই অঙ্গনটি শেখ হাসিনার জন্য কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বারবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ১৯ বার তিনি হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বর্বরোচিত হামলাটি হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।
একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরই মধ্যে তিনি শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন এবং দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ অসংখ্য পদক, পুরস্কার আর স্বীকৃতিতে।মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে আশ্রয়হীন দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে তাঁর উপস্থিতিতে বিশ্বনেতারা তাঁর এই মানবিক দৃষ্টান্তের প্রশংসা করেছেন। নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাঁকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে।
তিনি বাবা বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে দল ও দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। নেতৃত্ব গুণের কারণে তিনি এখন শুধু দক্ষিণ এশিয়া বা এশিয়া নয়, বিশ্ব নেতাদের কাতারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল। বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে অনুকরণীয়। স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, আইসিটি এবং এসএমই খাতে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন করার মধ্য দিয়ে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। একুশে ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিসহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি।
দাতাদের চাপে কৃষিতে ভর্তুকির কথা যখন অর্থনীতিবিদরা উচ্চারণ করেননি, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেন। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেন। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত নেন, যা আজ দৃশ্যমান। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ, কমিউনিটি ক্লিনিক, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বা আশ্রয়ণের মতো প্রকল্পের সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশকে।

রফিকুল ইসলাম সবুজ: প্রধান প্রতিবেদক, দৈনিক সময়ের আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *