ঘরে-বাইরে চাপ সামলানোর ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকার বাজেট

নিজস্ব প্রতিবেদক
বাইরের চাপ ঘরে এসেও পড়তে পারে। মানে চলমান আন্তর্জাতিক সঙ্কট দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেই চাপ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এ সময় তাকে কিছুটা বিমর্ষও দেখাচ্ছিল।

চাপ সামলানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, সামগ্রিকভাবে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এত চাপ কীভাবে সামলাবেন, তা নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় নানা ইঙ্গিতও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কোনো ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়িয়ে একদিকে যেমন রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগের কথা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে কর ছাড় দিয়ে ব্যবসায়ীদের খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন। সব শ্রেণির মানুষের জন্য কিছু না কিছু রেখেছেন আগামী বাজেটে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। বাজেটে কর্মসংস্থানকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যে কারণে দেশীয় শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটি গণমুখী ও জনমুখী বাজেট। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এটি আওয়ামী লীগের দলীয় বাজেট। ভবিষ্যতে আরও লুট করার বাজেট। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বাজেটে মূল্যস্ফীতি স্বীকার করে নেওয়া হলেও তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো প্যাকেজ নেই।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ৩টা ৫ মিনিট। সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট উপস্থাপনের জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিনের অনুমতি চান। শারীরিক কারণে স্পিকার অর্থমন্ত্রীকে বসে বাজেট পেশ করার অনুমতি দেন। এর আগে দুপুর ১২টায় লাল ব্রিফকেস নিয়ে সংসদে প্রবেশ করেন অর্থমন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় বাজেট অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে বেলা ৩টায় সংসদ কক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরনে ছিল বিস্কুট রঙের জামদানি শাড়ি। অর্থমন্ত্রীর পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি ও কালো মুজিব কোট। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপন শুরু হয়। এ সময় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গ্যালারি থেকে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন।

অর্থমন্ত্রীর প্রথম অধ্যায় পঠিত বলে গণ্য করা হয়। এর পরপরই ‘শেখ হাসিনা- এক ফিনিক্স পাখির গল্প’ শিরোনামে প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়। অর্থমন্ত্রী অল্প সময়ে বাজেট উপস্থাপনা করলে বাকি সময় পঠিত বলে গণ্য হয়।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, করোনার প্রভাব কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, তখনই মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। এই সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হলে বৈশি^ক অর্থনীতির করোনা পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সরকারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ওপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনীতির জন্য আরও একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা। বাজেট বক্তৃতায় কথাটি স্বীকারও করেছেন অর্থমন্ত্রী। এরপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বাড়ানোসহ সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন চতুর্থবারের মতো বাজেট দেওয়া এই অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। আবার আশঙ্কা প্রকাশ করেন, কোনো একটি সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানো।

আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। রাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য খাত থেকে পাওয়া যাবে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। সরকার পরিচালনা ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। শুধু ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এর আগে এত পরিমাণ ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বৈদেশিক ঋণের জন্য ব্যয় করতে হবে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণের জন্য ব্যয় করতে হবে মোট বাজেটের ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। ঘাটতি পূরণ করার জন্য ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও বৈদেশিক অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হবে।

অর্থনীতির প্রাণশক্তি দেশের মানুষের দেওয়া আয়কর। এর মধ্যে ৪ কোটি রয়েছে মধ্যবিত্ত। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ আয়কর দেন না। আয়কর বাড়ানোর জন্য আগামী বাজেটে করের জাল বাড়ানো হচ্ছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের বিধিবিধান আরোপ করা হবে। দেশীয় শিল্পকে সংরক্ষণ ও উৎসাহিত করতে কর রেয়াত থেকে শুরু করে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাজেটে।

পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। কৃষির সহায়তা কার্যক্রম থেকে শুরু করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে।

বাজেটে প্রবাসীদের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, যা আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বাজেটে আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হলে বেশি করে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন- সে কথা অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। সে ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাজেটে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা রাখা হচ্ছে। তবে বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে আভাস দিয়েছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে এখনও বেশ বিতর্ক রয়ে গেছে। এরপরও সামাজিক সুরক্ষা খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাতা বাড়ানো হবে। সাধারণ মানুষের জন্য সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগ আগামী বাজেটে থাকছে, যা সামাজিক সুরক্ষা দিতে সহায়ক হবে।

বেসরকারি খাতের উন্নয়ন নিয়ে প্রতিবছর বাজেটে কোনো না কোনো উদ্যোগ থাকে। আগামী বাজেটে এর ব্যত্যয় ঘটছে না। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা থেকে শুরু করে উৎসে করে আগামী বাজেটে ইতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলা যায়, আগামী বাজেট হচ্ছে ব্যবসাবান্ধব।

প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। কিন্তু করপোরেট কর কমছে ঠিকই। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। শিল্প খাত থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রফতানিমুখী শিল্প, ইস্পাতজাত বিবিধ শিল্প খাত, মোটরসাইকেল উৎপাদন খাত, রাবার শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পে বেশ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।

আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধিবিধানের কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। বিশেষ করে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে বলেও বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *