বদলী আদেশের পরে গণপূর্তে সর্বগ্রাসী লুটপাটে শিবির হালিম

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রায় পৌনে দুই মাস আগে বদলীর আদেশ পাওয়ার পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম ঢাকা- ৮ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম অনিয়ম ও দূর্নীতিতে আরও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিআইটি রাজশাহীর একসময়ের দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার হালিম কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী এমপির কাছের লোক পরিচয় দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে অনিয়ম লুটপাটে জড়িত থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

সংস্লিষ্টরা অভিযোগ করেন ২০০২ সালে রাজশাহী বিআইটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র শিবিরের মনোনয়নে আব্দুল হালিম শরীর চর্চা সম্পাদক নির্বাচিত হয়। বিএনপি জামায়াত জোট সরকার আমলের এই শিবির ক্যাডার বর্তমানে ভোলপাল্টে আওয়ামী লীগের এক এমপির কাছের লোক পরিচয় দিয়ে গণপূর্তে নানা অনিয়ম ও লুটপাটে জড়িত রয়েছে। এই নির্বাহী প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার যোবায়ের আহমেদ স্বাস্থ্যখাতের সব টেন্ডারে আব্দুল হালিমের নির্দেশে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে টাকা নিয়ে এসপার রেটে (প্রাক্কলিত দর) অনুযায়ী কাজ দিয়েছে। পিপিআর অনুযায়ী এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডার মেথড) অনুযায়ী দরপত্র হওয়ার কথা থাকলেও তা না করে ওটিএম এর মাধ্যমে টেন্ডার আহবান করে কাজ দেওয়া হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী হালিম ও সহকারি প্রকৌশলী যোবায়ের টেন্ডার আইডি হাইট করে রেখে যাদের কাছ থেকে টাকা নিত তাদেরকে আইডি ও রেট জানিয়ে দিত বলে অভিযোগ করেছেন সংস্লিষ্ট ঠিকাদাররা। তাদের দাবি পিপিআর অনুযায়ী ইজিপিতে এলটিএম এর বাইরে দরপত্র আহবানের সুযোগ নেই। এলটিএম এর ক্ষেত্রে প্রতি টেন্ডারে ১০ শতাংশ লেসে দর জমা পড়ে। এর মধ্যে লটারির মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়। এতে সরকারের সিডিউল বেশি বিক্রি হওয়ায় সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ লেসের কারনে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হয়।

কিন্তুু নির্বাহী প্রকৌশলী হালিম ও স্টাফ অফিসার যোবায়ের সিন্ডিকেট তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের প্রাক্কলিত মুল্যে কাজ দেওয়ায় সরকারের ১০ শতাংশ লেসের অর্থ লোকসান হচ্ছে। তবে এই ১০ শতাংশ টাকা প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার ভাগ করে নেয় তাদের নির্ধারিত কমিশনের বাইরে। সংস্লিষ্ট সুত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে বেশির ভাগ দরপত্রে মাত্র ১ জন ঠিকাদার অংশ নিয়েছে যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। অভিযোগ রয়েছে যারা ৫ শতাংশ টাকা দিতে রাজি হয়নি তাদেরকে ১০ শতাংশ লেসে কাজ নিতে বাধ্য করা হয়েছে।

এদিকে চলতি অর্থ বছরের শেষ মুহুর্তে এসে কয়েক দিন আগে ই/এম গণপূর্ত বিভাগ-৮ এর জন্য জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বৈদ্যুতিক কাজ ও তিনটি এয়ারকুলার লাগানোর জন্য এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় তলায় প্রশাসনিক ভবনে বৈদ্যুতিক ওয়ারিং ও সুইচ পরিবর্তনের জন্য ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, গার্ডেন লাইট ও সিকিউরিটি লাইটের জন্য ২৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ইমার্জেন্সি ব্লাকে এসির জন্য ১৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, রেটিনা ব্লাকের এসির জন্য ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ও প্রশাসনিক ব্লকে ভিআরিএফ এসির জন্য ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে অর্থ বছরের শেষ মুহুর্তে বরাদ্দকৃত এই অর্থের বেশির ভাগই লুটপাট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী তার বিদায়ের আগমুহুর্তে বিল পরিশোধ করে কমিশন নেওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন।

প্রসঙ্গত, নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিমের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অভিযোগের ভিক্তিতে গত ২৬ মে তাকে ই/এম বিভাগ- ৮ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘ প্রায় পৌনে দুই মাস সময় দিয়ে বদলীর আদেশ জারির কারনে শেষমুহুর্তে লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। জানা গেছে এই বদলী আদেশ বাতিলের জন্য আব্দুল হালিম তার এলাকা কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী এমপির কাছে যান। তবে ঐ এমপি প্রকৌশলীর হালিমের দুর্নীতি ও শিবির সংস্লিষ্টতার কথা জানতে পেরে তাকে বের করে দেন।

এর আগে গত বছর একজন ঠিকাদার অভিযোগ করেছিলেন নির্বাহী- প্রকৌশলী আবদুল হালিম ঠিকাদারি কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। ঐসময়ে নগরীর আশকোনাস্থ হজ ক্যাম্পের পাওয়ার লাইন, কম্বাাইন্ড সুইচ সকেট পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক কাজের অর্থ বরাদ্দ করানো হলেও নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কারিগরি অনুমোদন পেতে নিজ উদ্যোগেই টেন্ডার নেওয়ার প্রস্তাব দেন গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৮ (মিরপুর) এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিম। গণপূর্ত ই/এম উপবিভাগ-১৬ (মিরপুর) একজন উপ- সহকারি প্রকৌশলীর কাছ থেকে প্রাক্কলন পেতে সহযোগিতাও করেন তিনি।

আশকোনাস্থ হজ ক্যাম্পের প্রশাসনিক ব্লকের পাওয়ার লাইন, কম্বাইন্ড সুইচ সকেট পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক কাজ- নামক এ প্রাক্কলনের কারিগরি অনুমোদন পেতে আর্থিক সুবিধা নিয়ে স্বাক্ষর করেন আব্দুল হালিম। তখন ২ লাখ ২৮ হাজার ১৪৪ টাকার মুল্যের একটি প্রাক্কলনের কারিগরি চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে আটকে যায় ই/এম-৩, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর টেবিলে। তবে স্মারক নং- ই/এম-৮ ৭০/২৩০৩ প্রাক্কলনটির আরএপিপিতে কাজের তালিকায় ওঠানো হয়নি বলে জানিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশল কার্যালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ মার্চে প্রাক্কলনটিতে ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম। এসবের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী আসিফ গণমাধ্যমকে বলেন, তার সাথে আব্দুল হালিমের ভাল সম্পর্ক হয়। তিনি নিজ থেকে আন্তরিকতা দেখিয়ে টেন্ডার নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর তার ভিজিটিং কার্ডের উল্টো পাশে প্রাক্কলন সহযোগিতা দিতে একটা বার্তা লিখে গণপূর্ত ই/এম উপবিভাগ-১৬ (মিরপুর) উপ-প্রকৌশলী মো. আশরাফের কাছে পাঠান। প্রাক্কলনটি তৈরি ও তারই স্বাক্ষরের পর থেকে কারিগরি অনুমোদনে নির্বাহী প্রকৌশলীসহ একজন উপ-বিভাগীয় আরেকজন উপসহকারী প্রকৌশলীর স্বাক্ষর নিতে হয়। এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন মাস চলে যায়। এ সময়ের মাঝে যাতায়াত ভাড়াসহ ব্যাপক হয়রানির শিকার হতে হয়। স্বাক্ষরের পর স্মারক নম্বর রেজিস্ট্রার খাতায় ওঠাতে অফিসের স্টাফও পিয়নদের টাকা দিতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রাক্কলন সূত্রে জানা গেছে, আশকোনাস্থ হজ ক্যাম্পের প্রশাসনিক ব্লকের পাওয়ার লাইন, কম্বাইন্ড সুইচ সকেট পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিককরণ নামক কাজের একটা প্রাক্কলন তৈরি করেন গণপূর্ত ই/এম উপবিভাগ-১৬ (মিরপুর) উপ-প্রকৌশলী মো. আশরাফ। এর আগে গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৮(মিরপুর) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম কর্তৃক স্বাক্ষরিত তারই ভিজিটিং কার্ডের উল্টো পাশে একটা প্রাক্কলন তৈরির বার্তা লিখে ভুক্তভোগী আসিফকে কার্ডটি দেন তিনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্কলনটি তৈরি করে গত ২২ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষর দিয়ে আসিফের কাছে প্রাক্কলনটি হস্তান্তর করেন মো. আশরাফ। তবে গণপূর্ত ইম/এম উপ-বিভাগ-১৬ (মিরপুর) উপ-প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলামের নামে প্রাক্কলনটির কাজ দেখানো হয়।

প্রাক্কলন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপযুক্ত কাজের ব্যয় সম্ভাব্য নিরুপণের জন্য অত্র প্রাক্কলন খানা প্রস্তুত করা হইল। প্রাক্কলন প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তা এই যে, ঢাকার আশকোনাস্থ হজ ক্যাম্পটি সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। হজ ক্যাম্পের প্রশাসনিক ব্লকে একজন যুগ্ম সচিব অফিস করে থাকেন। অফিস রুমসহ সহকারী হজ অফিসারসহ পিএ রুমগুলোর সুইচ পাওয়ার ভাঙা। বৈদ্যুতিক ওয়ারিংগুলোর ক্যাবল জ¦লে গেছে। যা দ্রুত পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সুইচগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে অকেজো হয়ে গেছে।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, প্রাক্কলনের আইটেম সমূহের দর গণপূর্ত প্রধান প্রকৌশলীর অনুমোদিত সিডিউল ২০১৮ থেকে নেওয়া হয়েছে। যাতে প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২,২৮,১৪৪ টাকা। কাজটির ব্যয়ভার ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের কোড নং-৩২৫৮১০৭ অনাবাসিক ভবন খাতের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনার (এপিপি)ক্রমিক নং-৬৭ হইতে নির্বাহ করা হইবে।

গণপূর্ত ই/এম উপবিভাগ-১৬ (মিরপুর) উপ-প্রকৌশলী মো. আশরাফ কাজটির সদয় কারিগরি অনুমোদন প্রয়োজনে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী গণপূর্ত ই/এম উপ-বিভাগ-১৬ (মিরপুর),উপ-সহকারী প্রকৌশলী, গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৮ (মিরপুর) ও নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-৮ (মিরপুর) এর কাছে নিকট প্রেরণ করেন।

এদিকে প্রাক্কলনটি প্রেরণের পর অন্যান্য প্রকৌশলী কারিগরি অনুমোদনে স্বাক্ষর করে দিলেও যথা সময়ে স্বাক্ষর করেননি নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিম। তিনি এ প্রাক্কলন আটকে রেখে ভুক্তভোগী আসিফকে মাসের পর মাস ঘুরিয়েছেন। তাকে সকাল-বিকেল। আজকাল, পরশুর কথা বলে চরম হয়রানিতে ফেলেছেন। এর সাথে স্বাক্ষরের বিনিময়ে অর্থের সুবিধাও নিয়েছেন আব্দুল হালিম। গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিমের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য গনপূর্ত মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

এবিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হালিমের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *