নিজস্ব প্রতিবেদক
শোকাবহ আগস্টে প্রদর্শনের জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একটি ব্রডগেজ এবং একটি মিটারগেজ কোচ নিয়ে সারাদেশে প্রদর্শনের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই জাদুঘরটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সংগ্রাম, স্বাধীনতাযুদ্ধ আর ইতিহাসের সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ এই জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা স্টেশনগুলোতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকবে এবং ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রদর্শন করা হবে। দুটি কোচের একটি থাকবে দেশের পূর্বাঞ্চলে অন্যটি থাকবে পশ্চিমাঞ্চলের রেলস্টেশনে। জাদুঘরটি থকে বিনা টিকিটে সবাই পরিদর্শন করতে পারছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রেলের বগিতে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরটি নির্মাণ করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। একটি মিটারগেজ ও একটি ব্রডগেজ কোচে একই জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। জাদুঘর দুইটিতে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর নির্মিত তথ্যবহুল ও মনোমুগ্ধকর বারোটি পৃথক চিত্র ও দুর্লভ আলোকচিত্রের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে। সাধারণ দর্শনার্থীরা টাচ স্ক্রিনে আঙুল স্পর্শ করতেই ভেসে আসবে বঙ্গবন্ধু ছবি, ভাষণ, তার জীবনের নানা দিক-নির্দেশনা। প্রায় দেড় বছর সময় ধরে এটি তৈরি করা হয়েছে। দেশের ৮০ শতাংশ রেলস্টেশন গ্রাম-বাংলায় ছড়িয়ে রয়েছে। প্রান্তিক মানুষের কাছে জাতির পিতার ঐতিহাসিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রামী জীবনী তুলে ধরতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্রডগেজ কোচের জাদুঘরটি পশ্চিমাঞ্চল এবং মিটারগেজের জাদুঘরটি পূর্বাঞ্চলে প্রদর্শন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে এ জাদুঘরটি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, একটি ভারসাম্য যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু স্বাধীনতার পর আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে দিন দিন রেলপথকে সংকুচিত করে সড়ক পথের ওপর নির্ভরশীল বাড়ানো হয়। এতে সারাদেশে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রেলপথের সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেন। তারই উদ্যোগের ফলে সারাদেশকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, আদর্শ তার আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেলমন্ত্রী বলেন, এই ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা স্টেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে মৃত্যুপর্যন্ত তার কর্মজীবন রাজনৈতিক জীবন আত্মত্যাগ সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। জাদুঘর দুটিতে বঙ্গবন্ধুর জীবনের উপর নির্মিত তথ্যবহুল ও মনোমুগ্ধকর ১২টি পৃথক চিত্র ও দুর্লভ আলোকচিত্রের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে।কোচের একপাশের দেয়ালের ছয়টি ভাগে রাখা হয়েছে কিংবদন্তির প্রথম প্রহর, ধ্রুবতারার প্রথম কিরণ, নক্ষত্র হওয়ার পথে, বাংলার মাটি ও ভাষার বঙ্গবন্ধু, ধূমকেতু থেকে নক্ষত্র, মুক্তির স্বপ্নের সূচনা শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত। এখানে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে পর্যায়ক্রমে তার ছাত্রজীবন, রাজনীতিতে হাতেখড়ি এবং গণমানুষের প্রাণের নেতা হয়ে উঠার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে মহাপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনী আত্মত্যাগ এবং তার রাজনৈতিক দর্শনকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বাংলাদেশ রেলওয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল যাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছে। এ জাদুঘরের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে জানার সুযোগ পাবেন।
বঙ্গবন্ধু রেল জাদুঘরের মূল
পরিকল্পনাকারি অতিরিক্ত
মহাপরিচালক মঞ্জুর উল
আলম চৌধুরী:
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর’ নির্মাণের মূল ভাবনা ও পরিকল্পনাকারি হলেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অভিনব উদ্ভাবনী কাজটির প্রশংসা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্জুর উল আলম চৌধুরীর লেখা ‘তুমি ইতিহাস জুড়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক এই বাংলার তুমি শোষকের যম শোষিতের দম স্রষ্টা স্বাধীনতার’ গানটিকে জাদুঘরের থিম সং হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কোচ দুটির বাইরের অংশে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ধারাবাহিক সংগ্রামের উপর শিল্পীর আঁকা রঙিন ম্যুরালের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতির বাইরেও একজন সৎ, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী সুপরিচিত। ১০ম বিসিএসে রেলওয়ের দুইটি ক্যাডারে কর্মরতদের মধ্যে পিএসসির মেধাতালিকায় প্রথম ছিলেন তিনি। তার পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর’ গত ২৭ মে উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় শহিদ হওয়া শ্রমিকদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ। সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে ২০১৩ সালে রেলের অকেজো যন্ত্রাংশ ও মালামাল দিয়ে নির্মাণ করা হয় ‘অদম্য স্বাধীনতা’ নামের এই স্মৃতিসৌধ। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাশ্রম ও নিজেদের অর্থ দিয়েই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে রেলওয়ে তাদের সেবা বহুমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি স্কয়ার হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করতে যাচ্ছে ইমারজেন্সি হসপিটাল কাম অ্যাম্বুলেন্স। এই কাজের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর’ রেলের ইতিহাসে প্রথম ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর। একটি ব্রডগেজ ও একটি মিটারগেজ কোচকে সর্বোচ্চ প্রযুক্তিতে সাজানো হয়েছে। জাদুঘরটিতে ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাতির পিতার ঐতিহাসিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রামী ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তার জীবন দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে একটি জাতির জন্য আত্মত্যাগ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার স্মৃতিকে জীবন্ত করে রাখতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে দুটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উদ্যোগ দুটির একটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘর অন্যটি হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার লেখা একটি থিম সং।
ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘরে আরও রয়েছে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবর্ননীয় নির্যাতন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট, মিথ্যা মামলা ও কারাভোগ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ইতিহাস। আরেক পাশের দেয়ালে থাকা ছয় ভাগে রয়েছে, দুর্বার পথচলা, নিপীড়িতদের কাণ্ডারি, এক নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন, মুক্তি, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার কথা, স্বপ্নগড়ার দিনগুলো, যে আলো নেভেনি আজও এমন শিরোনামে শিল্প প্রদর্শনী। এতে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও জাতির গৌরবোজ্জ্বল, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের প্রধান নায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদান দর্শকদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন দর্শকরা ভালোভাবে শুনতে পারেন সেজন্য রাখা হয়েছে হেডফোনের ব্যবস্থা। কোচের এক প্রান্তে রাখা একটি বড় এলইডিতে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ও ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণ। এ ছাড়া শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর রচিত বিভিন্ন শিশুতোষ বইও রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জাদুঘরটিতে। জয়বাংলা স্লোগানের আদলে তৈরি করা একটি বুক শেলফ রয়েছে। সেখানে প্রায় একশ বই রয়েছে। জাদুঘরটিতে ‘যাদু মনি’ সম্বোধন করে মেয়ে হাসুকে (শেখ হাসিনা) নিয়ে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠিসহ মোট ছয়টি চিঠি রাখা হয়েছে। যা দর্শনার্থীদের বঙ্গবন্ধুকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।