৫০ বছরে জাতীয় সংসদে ২,৭৯৭ কার্যদিবসে ১,৫২২ টি আইন পাস

রফিকুল ইসলাম সবুজ:
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ঐ বছরের ৭ এপ্রিল। সেই হিসেবে আজ ৬ এপ্রিল সংসদের ৫০বছর পূর্তি হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টায় বসছে সংসদের বিশেষ অধিবেশন। চলবে আগামী রোববার পর্যন্ত ৪ কার্যদিবস। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ স্মারক বক্তৃতা দেবেন। এরপর সংসদে সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপন করবেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের দুই দিনের আলোচনা শেষে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। এ উপলক্ষ্যে স্মারক ডাক টিকিট ও বই প্রকাশিত হবে বলে সংসদ সচিবালয় সুত্র জানিয়েছে।

৫০ বছরে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ১১টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৫ বার এবং বিএনপি ৪ ও জাতীয় পার্টি ২ বার করে জয়ী হয়েছে। ১১টি সংসদে এপর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২,৭৯৭ কার্যদিবসে ১৭ বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে। আর আইন পাস হয়েছে ১,৫২২টি। তবে এর মধ্যে মুল আইন রয়েছে প্রায় ৫ শ’টি। বাকিগুলো সংশোধনী আইন। একই আইন ৫ থেকে ১০ বার সংশোধনের রেকর্ডও রয়েছে। তবে আইন প্রনেতারা জানিয়েছেন, সংসদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে দেশবাসীকে নিজস্ব সংবিধান উপহার দেওয়া। বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে (বর্তমানে জাতীয় সংসদ) এই সংবিধান গৃহীত হয় এবং একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকী হতে এটি কার্যকর হয়।

১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত  ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২’ জারি করা হয়। এই আদেশ বলে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন এবং তা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকরী বলে ঘোষিত হয়।

সংসদ সচিবালয় সুত্র জানায়, সংসদে পাস হওয়া প্রায় ৫ শ’টি মূল আইনের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠনের লক্ষ্যে প্রণীত পদ্ধতিগত আইন রয়েছে প্রায় তিন শ’। সংসদের বড় সাফল্যের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় বিধান করে আইন পাস হওয়া। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষে নবম সংসদে যুগান্তকারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন পাস হওয়া। আর নবম সংসদেই দেশের প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন চৌধুরী। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি বাদে সবকটি আসনেই জয়ী হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারি দল আওয়ামী লীগ। প্রথম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ৭ এপ্রিল। এ সংসদের সংসদ নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম সংসদের মেয়াদ ছিল ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রথম সংসদে কোন বিরোধী দলীয় নেতা ছিল না। ১৩৪ কার্যদিবস চলা প্রথম সংসদে ১৫৪ টি আইন পাস হয়। এর মধ্যে সংশোধনী আইন ছিল ৮১টি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালে দি রিপ্রেজেন্টেশন অব দি পিপল সাপ্লিমেন্টারি (সংশোধন) আইনটি প্রথম প্রণীত হয়। এর পরপরই পাস হয় বাংলাদেশ সরকারি হাটবাজার ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন-১৯৭৩।
দ্বিতীয় সংসদে (১৯৭৯ সালের ২ এপ্রিল থেকে  ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ) ২০৬ কার্যদিবসে আইন পাস হয় ৬৫টি। এ সংসদে বিএনপি সংখ্যাগরিস্ট দল এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তৃতীয় জাতীয় সংসদে (১০ জুলাই, ১৯৮৬ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭) ৭৫ কার্যদিবসে ৩৯ টি আইন এবং চতুর্থ জাতীয় সংসদে (১৫ এপ্রিল, ১৯৮৮ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) ১৬৮ কার্যদিবসে ১৪২ টি আইন পাস হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এ সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এইচ এম এরশাদের নিযুক্ত সম্মিলিত বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন আ স ম আব্দুর রব।

পঞ্চম জাতীয় সংসদে (৫ এপ্রিল, ১৯৯১ থেকে ২৪ নভেম্বর, ১৯৯৫) ৪০০ কার্যদিবসে ১৭৩টি আইন এবং  ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে (১৯ মার্চ, ১৯৯৬ থেকে ৩০ মার্চ, ১৯৯৬) ৪ কার্যদিবসে ১ টি আইন পাস হয়। সপ্তম জাতীয় সংসদে (১৪ জুলাই, ১৯৯৬ থেকে ১৩ জুলাই, ২০০১) ৩৮২ কার্যদিবসে ১৯১ টি আইন এবং অষ্টম জাতীয় সংসদে (২৮ অক্টোবর, ২০০১ থেকে ২৭ অক্টোবর, ২০০৬) ৩৭৩ কার্যদিবসে ১৮৫ টি আইন পাস হয়। নবম জাতীয় সংসদে ৪১৮ কার্যদিবসে ২৭১ টি আইন, দশম জাতীয় সংসদে (২৯ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ৩ জানুয়ারি ২০১৯)  ৪১০ কার্যদিবসে ১৯৩টি আইন পাস হয়। এছাড়া বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদে মার্চ পর্যন্ত  ১০৮টি আইন পাস হয়েছে। বর্তমান সংসদে  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জš§শতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন করা হয়।

অন্যদিকে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। ১১টি সংসদের মধ্যে সপ্তম ও বর্তমান একাদশ সংসদ বাদে প্রতিটি সংসদেই সংবিধান সংশোধন হয়েছে। প্রথম সংসদে সব চেয়ে বেশি ৪ বার সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সপ্তম সংসদে এবং বর্তমান একাদশ সংসদে গত দুই বছরে সংবিধানে কোনও সংশোধন হয়নি।
সংসদ নেতা হিসেবে শাহ আজিজুর রহমান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও খালেদা জিয়া পৃথক পাঁচটি সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বাকি বিলগুলো আইনমন্ত্রীরাই উত্থাপন করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধান পায় বাংলাদেশ। ওই বছরের ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল পাস হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। সংবিধানের প্রথম সংশোধনীটি ছিল যুদ্ধাপরাধীসহ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে এই সংশোধনীর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা হয়।
১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বিল পাস হয়। এতে সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদে (২৬, ৬৩, ৭২ ও ১৪২) সংশোধনী আনা হয়। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিরাক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার বিধান চালু করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে।
ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণী একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর তৃতীয়  সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় বিধান প্রণয়ন করা হয়।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় ২০১১ সালের ৩০শে জুন। এই সংশোধনী দ্বারা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়। এই সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫-এর স্থলে ৫০ করা হয়। সংবিধানে ৭ অনুচ্ছেদের পরে ৭ (ক) ও ৭ (খ) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধান বহির্ভূত পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ করা হয়।

বছরব্যাপী থাকবে নানা আয়োজন:
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী উপলে বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী  জানান, ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিধায় ৭ এপ্রিল সংসদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেই দিনটি উদযাপনের সুযোগ পাওয়া অনেক গৌরবের বিষয়। তাই ৬ এপ্রিল বিশেষ অধিবেশন শুরু হলেও ৭ এপ্রিল বিশেষ অধিবেশনের মূল কার্যক্রম শুরু হবে। ওইদিন রাষ্ট্রপতি সংসদে আসবেন এবং অধিবেশনে স্মারক বক্তৃতা দেবেন। এরপর সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় সাধারণ আলোচনার জন্য প্রস্তাব তুলবেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই প্রস্তাবের উপর সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। আলোচনায় ১৯৭৩ সালের সংসদের সদস্যদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ অধিবেশনের আলোচনাগুলো লিপিবদ্ধ করে তা বই আকারে প্রকাশ করা হবে। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বিশেষ অধিবেশন ছাড়াও জাতীয় সংসদে সারাবছর নানা কর্মসূচী থাকবে।

বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষ্যে শুক্রবার রাষ্ট্রপতির স্মারক বক্তৃতার দিনে দেশি-বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মারক ডাকটিকিট উš§ুক্ত করার কর্মসূচি রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। যেটা বাজেট অধিবেশনের পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে হতে পারে। ওই অনুষ্ঠানে অন্যান্য দেশের স্পিকার, সংসদ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। এছাড়া আলোচনা সভা, সেমিনার, প্রদর্শনী, মেলাসহ নানা আয়োজন থাকবে। বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্যদের মিলনমেলাও হতে পারে। ওই সকল অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ৫০ বছরের অর্জনগুলো প্রচার করা হবে। বিশ্বের সংসদীয় ফোরামগুলোতে জাতীয় সংসদের ভূমিকাও তুলে ধরা হবে। সংসদে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণগুলো দেশে-বিদেশে প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে। মেলায় দেশের ঐতিহ্যবাহি পণ্যের প্রদর্শনী থাকবে।

সুত্র : দৈনিক সময়ের আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *