৫০ কোটি টাকার ড্রেজিং করেও চালু করা যায়নি ফেরি রুট: পুরো টাকাই জলে

নিজস্ব প্রতিবেদক:
৫০ কোটি টাকার ড্রেজিং করেও চালু করা যায়নি বালাশী (গাইবান্ধা)-বাহাদুরাবাদ ঘাট (জামালপুর) ফেরি রুটটি। নানা অনিয়ম দূর্নীতি এবং সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্প করায় ড্রেজিং এর পুরো টাকাই জলে গেছে। এখনও এখানে নিয়মিত ড্রেজিং করা হচ্ছে বলে জানান সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গাইবান্ধার ফুলছড়ির বালাশী ফেরিঘাট টার্মিনাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে বিশাল দুটি প্রবেশদ্বারের সঙ্গে ভেতরে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, আনসার ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, ফেরির নাবিকদের ব্যারাক, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, জেনারেটর সাবস্টেশন, বিশ্রামাগার, মসজিদ, রেস্তোরাঁ ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা সবই করা হয়েছে। কিন্তু নদীতে চর পড়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধান ও গমের ক্ষেত হওয়ায় এখানে নেই কোন ফেরি। আর ফেরি না থাকায় টার্মিনালের কোন কার্যক্রমও নেই। অথচ এই বালাশী -বাহাদুরাবাদ ঘাট রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করতে নৌ-টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। কিন্তুু নাব্যতা সংকটের কারণে দুই বছর আগে এসব স্থাপনা নির্মাণ সম্পন্ন হলেও ফেরি সার্ভিস চালু করা সম্ভব না হওয়ায় নৌ-টার্মিনাল ও নয়নাভিরাম অবকাঠামো এখন নষ্ট হতে চলেছে।

বালাশী ঘাটের দোকানকার আবদুর রহমান বলেন, ‘নদী নাই বন্দর করেছে। ফেরী চলবে কি চাকা লাগাইয়া?’ সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় ফেরি রুটটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন গাইবান্ধার বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, ড্রেজিং এর নামে বিআইডব্লিউটিএ’র কিছু কর্মকর্তার পকেট ভারি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতেই এই অভিনব প্রকল্পটি করা হয়েছিল। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) নিজাম উদ্দিন পাঠান জানিয়েছেন, ঐসময়ে প্রকল্পের অধিনে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ড্রেজিং করা হয়। তাছাড়া প্রকল্পের বাইরে বিআইডব্লিউটিএর ৬ টি ড্রেজার দিয়েও ড্রেজিং করা হয়েছিল। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে এখনো নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে এখানে নিয়মিত ড্রেজিং করা হচ্ছে।

উত্তরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ করতে নেওয়া এই প্রকল্পটির কাজ ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার পর বিআইডব্লিউটিএ গঠিত কারিগরি কমিটির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই পথ ফেরি চলাচলের উপযোগী নয়। স্থানীয়রা জানান, বালাশী গ্রামটির বেশির ভাগই যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ২০ বছর আগে। তারপরও ঘাটটি বালাশী ঘাট নামেই রয়ে গেছে। এলাকার বাসিন্দা মানিক মিয়া জানান, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দুরে লঞ্চ ঘাটটি চলে গেছে। নদীর মধ্যে চর পড়ে ফসলের ক্ষেত হয়েছে। তিনি জানান, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জেও বালাশী ঘাটের মতো ফেরি টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে বালাশী ফেরিঘাট টার্মিনালে কোন লোকজন নেই। শুধুমাত্র কয়েক জন আনসার সদস্য টার্মিনালটির পাহারার দায়িত্বে রয়েছে। টার্মিনালটির সঙ্গে কোন পল্টুন নেই। কারণ টার্মিনালের সঙ্গে নদীর কোন অস্তিত্বই খুজে পাওয়া যাবে না। স্থানীয়রা জানান, টার্মিনাল থেকে নদীর পানি খুজে পেতে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দুরে যেতে হবে। আর এই সাড়ে তিন কিলোমিটার জায়গা জুড়ে চর পড়েছে যেখানে ধান ও গমের ক্ষেত করেছেন কৃষকরা।

গাইবান্ধার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে যমুনা নদীতে নাব্যতা হ্রাসের কারণে বালাশী-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধের উপক্রম হয়। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হয়। ফলে ২০০০ সাল থেকে এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অকার্যকর হয়ে পড়ে বালাশীঘাট। তখন থেকে বালাশী-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ আছে। তবে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে পারাপার অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে বিকল্প পথ তৈরি করার যুক্তি দেখিয়ে ২০১৪ সালে বালাশী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে একনেকের সভায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর এই ফেরিঘাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরে দুই দফায় টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি টাকার এ প্রকল্প শেষ করা হয়। গাইবান্ধার বালাশী ও জামালপুরের বাহাদুরাবাদের ২৬ কিলোমিটার নৌপথ। প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে আসায় ওই পথ দিয়ে কয়েক দফায় পরীক্ষামূলকভাবে ফেরি চালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুই দফায় ট্রায়াল রান করতে গিয়ে নাব্য সংকটে দুবারই আটকে যায় বিআইডব্লিউটিসির খালি ফেরি। ফলে ফেরি চালানো সম্ভব হয়নি। এরপর ২০২১ সালের এপ্রিলে নৌরুটটির সমস্যা খুঁজে দেখতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) একটি কমিটি করে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, যমুনা নদী খুবই পরিবর্তনশীল এবং ঘন ঘন রুট পরিবর্তন করায় নৌপথ সংরক্ষণ করতে বছরে ৩২ থেকে ৩৩ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করতে হবে। ফেরি চালাতে হলে এ রুটে সার্বক্ষণিক ছয় থেকে সাতটি ড্রেজার রাখতে হবে। বছরে ব্যয় হবে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা। এ কারণে বারবার উদ্যোগ নিয়েও এ রুটে ফেরি চালু করতে পারেনি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়।

বিআইডব্লি¦উটিএর কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের অধিনে নৌরুটটি সচল করতে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ড্রেজিং করা হয়। অভিযোগ রয়েছে ড্রেজিং এর নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বালাশী ঘাটের দোকানকার আবদুর রহমান বলেন, বিআইডব্লিউটিএ কিছু দিন পর পর এক জায়গা থেকে বালু তুলে আরেক জায়গায় ফেলে আর তেল বেঁচে। এর ফলে স্থানীয় আবাদী জমি নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারাও জানান, ড্রেজিং এর নামে লুটপাট হওয়ার কারনে নাব্য সংকট তৈরি হয়েছে। একারনে প্রায়ই এই রুটে ডুবোচরে লঞ্চ আটকে যায়। তারা বলেন, শুনেছি এই রুট খননের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কি খনন হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। যেখানে লঞ্চ চলাচল করতে পারে না ফেরী তো সেখানে স্বপ্নের মত। শুধু শুধু সরকারের টাকাগুলো নষ্ট করা হয়েছে।

গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, রাষ্ট্রীয় ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প কোন কাজেই আসছে না। এই বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি ও দুর্নীতির উৎস খুঁজে বের করার দাবি জানান তিনি।

বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, নদীতে নাব্যতা না থাকার কারনে ফেরিঘাট টার্মিনালটি চালু করা যায়নি। তাই ফেরি সার্ভিসও বন্ধ রয়েছে। তবে দুটি লঞ্চ দিয়ে যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। একারনে এই ঘাটটি ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বাঘাবাড়ি ঘাট থেকে স্টাফ দিয়ে খাস কালেকশন করা হচ্ছে।

বালাশী- বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করতে নৌ-টার্মিনাল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) নিজাম উদ্দিন পাঠান জানান, প্রকল্প অনুমোদনের আগে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়সহ ১২টি ডিপার্টমেন্ট মিলে একটি প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএর ডিপার্টমেন্টাল একটা স্টাডি করা হয়েছিল। তার পরেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। নদী শুকিয়ে যাওয়ার পরও কেন প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই নদীটি খুবই পরিবর্তনশীল এবং ঘন ঘন রুট পরিবর্তন করে যা স্টাডি েিরেপার্টেও তুলে ধরা হয়েছিল। তবে কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে বলায় তা করা হয়েছে। প্রকল্পটি সচল করার চেষ্টা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা চালু হলে এলাকার মানুষের অনেক উপকার হবে।

##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *