রফিকুল ইসলাম সবুজ
বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক সময়ের আলো।
লুই আই কানের নকশা অনুসরণ করে জাতীয় সংসদ ভবনের সংস্কার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে সংসদ ভবনের ভেতরের কাঠের তৈরি বিভিন্ন কক্ষসহ নকশাবহির্ভূত বিভিন্ন স্থাপনা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে নকশা মেনে সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজার ৫২ হাজার স্কয়ার ফুট ফাঁকা জায়গার মধ্যে ৩৬ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গায় অত্যাধুনিক অফিসকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্যাবিনেট কক্ষ, স্থায়ী কমিটি কক্ষ-১, ২ ও ৩ এবং শপথ কক্ষের আধুনিকায়ন কাজও সম্পন্ন করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেছেন।
অন্যদিকে জাতীয় সংসদ ভবনের নীচতলায় লাইব্রেরীর পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আর্কাইভ। সেখানে থাকবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতার বিভিন্ন ছবি ও ডকুমেন্ট। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার সব ওয়াকওয়ে ও ফুটপাথের নষ্ট হয়ে যাওয়া ইট (পেভমেন্ট ব্রিকস) পরিবর্তন কাজসহ ফেয়ার ফেস দেয়ালে ও সিরামিক ব্রিক সার্ফেসে ওয়াটার রিপিলেন্ট প্রয়োগের কাজও করা হচ্ছে। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার টেম্পার নষ্ট হওয়া ইট (পেভমেন্ট ব্রিকস) পরিবর্তনসহ আধুনিকায়নের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এসব উন্নয়ন কাজ শেষ হলে আরও আকর্ষনীয় হবে সংসদ ভবনের ভেতর ও বাইরের চেহারা।
সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মূল নকশা হাতে না থাকায় জাতীয় সংসদ ভবনে অবকাঠামোগত সংস্কারে ঝামেলায় পড়তেন তারা। সংসদ চত্বরে নতুন কোনো কাজে হাত দেয়া নিয়েও দেখা দিত জটিলতা। তবে জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা আসার পর সেটি ধরে সংসদ ভবনে সংস্কারকাজ হচ্ছে। চিহ্নিত করা হয়েছে নকশাবহির্ভূত স্থাপনা। তবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরসহ সংসদ ভবন এলাকায় গড়ে ওঠা নকশাবহির্ভূত অন্যান্য স্থাপনাও সরিয়ে ফেলার দাবি থাকলেও এ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আপাতত এবিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেই বলে জানা গেছে।
সংস্লিস্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৯৮৪ সালে উত্তর প্লাজা নির্মিত হওয়ায় দীর্ঘদিন ব্যবহার জনিত কারনে রেড ব্রীকের স্থায়ীত্ব নষ্ট হয়ে গেছে ফলে বৃষ্টি হলেই ব্রীক সারফেস ও জয়েন্ট সমুহে শ্যাওলা ও ঘাস জন্মায়। একারনে উত্তর ও দক্ষিণ প্লাজার উপরিতলে বিদ্যমান পুরাতন সিরামিক ব্রীক ও মার্বেল পাথর সম্পুর্ণরুপে অপসারণ করে কংক্রিট ছাদের উপরিভাগে পানি নিরোধী কটিং স্থাপন করে লুই আই কানের নক্সা অনুযায়ী বর্তমান সংসদ ভবনের স্থাপত্য শৈলী ও নান্দনিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে একই রং এবং আকৃতির নতুন সিরামিক ব্রীক এবং মার্বেল পাথর যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে লুই আই কানের নকশা অমান্য করে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতরে ও বাইরে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশেষ করে সংসদ ভবনের ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার পথ বন্ধ করে তৈরি করা হয়েছিল কক্ষ। সংসদ সচিব, বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের একান্ত সচিবসহ কর্মকর্তাদের এসব কক্ষ তৈরি হয়েছিল, যা মূল নকশায় ছিল না। নকশাবহির্ভূত কাঠের তৈরি এসব কক্ষ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজের জন্য গত বছরের অক্টোবর থেকে ৯২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এ প্রকল্পের অধিনে জাতীয় সংসদ ভবনের ক্যাবিনেট কক্ষ, স্থায়ী কমিটি কক্ষ-১, এবং শপথ কক্ষের আধুনিকায়ন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া সংসদ ভবনে বঙ্গবন্ধু আর্কাইভ নির্মাণ, স্থায়ী কমিটি কক্ষ-২ ও ৩, সংসদ ভবন এলাকার সব ওয়াকওয়ে ও ফুটপাথের নষ্ট হয়ে যাওয়া ইট (পেভমেন্ট ব্রিকস) পরিবর্তন কাজসহ ফেয়ার ফেস দেয়ালে ও সিরামিক ব্রিক সার্ফেসে ওয়াটার রিপিলেন্ট প্রয়োগের কাজ চলছে। জাতীয় সংসদ ভবনের মন্ত্রী হোস্টেল ব্লকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্টুডিও নির্মাণ ও আধুনিকায়নের কাজ, জাতীয় সংসদ ভবনের মন্ত্রী হোস্টেল এলাকায় পুলিশ ব্যারাক পুননির্মাণ কাজও করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদ এবং সংসদ সদস্য ভবন নং-২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ এর বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ও নিরাপত্তাজনিত কাজ এবং আরবরিকালচার ও পূর্ত কাজের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় হচ্ছে।
গণপূর্ত অধিদফতরের শেরেবাংলা নগর-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর নির্দেশনা অনুযায়ী সংসদ ভবনের ভেতরে ও বাইরে মুল নকশা অনুযায়ী সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। তিনি জানান, উত্তর প্লাজার নকশাবহির্ভূত বিভিন্ন স্থাপনা সরিয়ে নকশা মেনে কর্পোরেট আদলে অত্যাধুনিক অফিসকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্যাবিনেট কক্ষ, স্থায়ী কমিটি কক্ষ-১, ২ ও ৩ এবং শপথ কক্ষের আধুনিকায়ন কাজও সম্পন্ন করা হয়েছে। এসব নির্মাণ কাজের ইন্টেরিয়র ডিজাইন প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে অনুমোদনের পরই কাজ করা হয়েছে। দক্ষিণ প্লাজার টেম্পার নষ্ট হওয়া ইট (পেভমেন্ট ব্রিকস) পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, সংসদ ভবন নির্মাণের সময় যে ইট ব্যবহার করা হয়েছিল ঠিক একই মানের সিরামিক ইট ব্যবহার করে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। ইট পরিবর্তনের কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দক্ষিণ প্লাজার নিচে গুরুত্বপূর্ন এমএমপি কক্ষে সংসদ ভবনের মুল সাবস্টেশন, কন্ট্রোল প্যানেল, সেন্ট্রাল এসির চিলারসহ মুল্যবান ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি থাকে। কিন্তুু ইটের টেম্পার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির সময় পানি পড়ে। এতে এমএমপি কক্ষের ডকুমেন্ট নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী সংস্কার করা হচ্ছে। তিনি জানান, পুরাতন ইট তুলে ছাদ থেকে পানি পড়াব বন্ধ করার জন্য আরসিসি ঢালাই দেওয়ার পর নতুন ইট বসানো হয়েছে। এ কাজে ব্যয় হচ্ছে ১৪ কোটি টাকা। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ আমাদের দেশের প্রধান স্থাপনা হিসেবে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং এর সার্ভিস টিকিয়ে রাখার জন্য এই সংস্কার কাজ খুবই প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং প্রধান প্রকৌশলীসহ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারাও গুরুত্বপূর্ন এ সংস্কার কাজ যাতে সঠিক ভাবে হয় সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সংসদ ভবন নির্মাণের পর থেকে দীর্ঘদিন বড় ধরনের কোনো সংস্কার কাজ না হওয়ায় ধীরে ধীরে এর জৌলুস হারাতে বসেছিল। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে বর্তমান সরকার এর আগের মেয়াদে ‘জাতীয় সংসদের পূর্তকাজ, বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক সিস্টেমের উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি আমব্রেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সংসদ ভবন এখন আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ২৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় সংসদ ভবন, সংসদ সদস্য ভবন ও এমপি হোস্টেলসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ ও আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল।
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী জানান, স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশার আলোকে পুরো জাতীয় সংসদ ভবনকে সাজানো হচ্ছে। মূল নকশার আলোকে সাজানোর পাশাপাশি সংসদ ভবনের পরিবেশ উন্নয়নে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী সংস্কার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, জাতীয় সংসদ ভবনের স্থাপত্যশৈলী আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দিত। সংসদকে লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী সাজানো হচ্ছে।
স্থাপত্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদের যেসব নকশা সরকারের হাতে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় সেসবের বেশ কিছু নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া পুরো বিল পরিশোধ না হওয়ায় নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও সংসদের সব নকশা হস্তান্তর না করায় বাংলাদেশের কাছে পুরো নকশা ছিল না। স্থাপত্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সংসদ ভবনে সংস্কার ও সম্প্রসারণকাজে সমস্যা হওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানোর পর ২০১৪ সালে তিনি সংসদের মূল নকশা আনার নির্দেশনা দেন। এরপর লুই আই কানের প্রতিষ্ঠান ডেভিড অ্যান্ড উইজডমের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে স্থাপত্য অধিদপ্তর। নকশাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচারাল আর্কাইভে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে সেখানেও যোগাযোগ করা হয়। অতঃপর পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদের তিন সেট নকশা আনে সরকার। নকশার একটি করে কপি আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় সংসদ ভবন এবং স্থাপত্য অধিদপ্তরে রাখা হয়েছে। নকশাবহির্ভূত স্থাপনাগুলোও চিহ্নিত করে মূল নকশা ধরে সংসদ ভবনে অবকাঠামোগত সংস্কারকাজ করা হচ্ছে। তবে সংসদ চত্বর থেকে জিয়াউর রহমানের কবরসহ নকশাবহির্ভূত অন্য স্থাপনাগুলো সরানো নিয়ে স্থাপত্য অধিদপ্তর এবং সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে এখনো কোনো নির্দেশনা নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, জিয়ার কবরসহ অন্য স্থাপনাগুলো সরাতে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের অষ্টম ও শেষ অধিবেশনে প্রথম সংসদ ভবন ব্যবহৃত হয়। তখন থেকেই আইন প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কেন্দ্র হিসেবে এই ভবন ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
##