রফিকুল ইসলাম সবুজ:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনে নিয়মরক্ষার নির্বাচন শেষে জয়ী এমপিরা শপথ নিয়ে সংসদে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। সব কিছুই হয়েছে দেশের সংবিধান অনুযায়ী। কিন্তুু যখন সারাদেশের ৩০০টি নির্বাচনী আসন থেকে সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে থাকছেন, তখন এই সংরক্ষিত নারী আসনের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব আসলে কতটা তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যরা সংসদে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় বা রাজনৈতিক পরিবার থেকেই সাধারণত সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয়। কাজেই রাষ্ট্র পরিচালনায় বা সংসদের কার্যক্রমে অবদান রাখতে পারবেন এমন বিবেচনায় সাধারণত সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচন করা হয় না। আবার যোগ্যতা থাকার পরও দলীয় আনুপাতিক কোটার কারনে সংরক্ষিত আসন থেকে সংসদ সদস্য হতে পারেন না অনেক যোগ্য নারী নেত্রী। সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিতদের কার্যপরিধির ব্যাপ্তি বা দায়িত্বের বিষয়ে আমাদের সংবিধানে আলাদাভাবে উল্লেখ নেই। সংবিধানে শুধু বলা আছে, সংরক্ষিত আসন থাকতে হবে, সেটির সংখ্যা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন করা হয়েছে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র এমপিদের সমর্থন থাকায় এবার আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮টি এবং জাতীয় পার্টি ২ টি সংরক্ষিত আসন। আইন অনুযায়ী শপথ নেয়া সংসদ সদস্যরাই সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে ভোটার হবেন এবং এই ভোটাররা কেবল নিজেদের দলের প্রাপ্ত আনুপাতিক আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে বণ্টিত আসনে একক প্রার্থী হলে ভোটগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু বণ্টিত আসনের তুলনায় ওই দল বা জোটের প্রার্থী বেশি হলে ভোট নিতে হবে। কিন্তুু সংরক্ষিত আসনের জন্য কখনোই ভোটের প্রয়োজন পড়েনি।
সংসদে আইনপ্রণেতা হিসেবে একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মতো সমান অধিকার থাকে একজন সংরক্ষিত আসনের সদস্যের। সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা নিজের এলাকাসহ বিভিন্ন ইস্যু সংসদে উপস্থাপন করার অধিকার রাখেন। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যদের জন্য কোনো নির্ধারিত নির্বাচনী এলাকা নেই। তারা কেবল দলীয় বা জোটের সদস্য হিসেবে পরিচিত হন। এক্ষেত্রে দল বা জোটের প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে মহিলা আসন বণ্টিত হবে। কিন্তুু সাধারণ আসনের সংসদ সদস্যদের মতো তাদের নির্দিষ্ট কোন নির্বাচনী এলাকা না থাকায় জনগনের কাছে তাদের কার্যত কোন জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে সংসদে কথা বলা ছাড়া এলাকার উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডে অনেকেরই তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায় না। তাই সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তন করে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে নারী নেতৃত্ব আরও গতিশীল হবে বলে মনে হয়। কারণ প্রতিবেশী দেশ ভারতেও লোকসভা ও বিধানসভায় সংরক্ষিত আসন রয়েছে। তাদের সংরক্ষিত আসন মুলত জাতিভিত্তিক অর্থাৎ উপজাতিসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য সংরক্ষিত। ঐসব আসনে সরাসরি ভোট হয় তবে সেখানে সবাই ভোট দিতে পারলেও বিভিন্ন দল প্রার্থী দিতে পারে কেবলমাত্র যে জাতি বা উপজাতির জন্য সংরক্ষিত তাদের মধ্য থেকে। যেমন ত্রিপুরা রাজ্যে ৬০টি বিধান সভা আসনের মধ্যে ৪০টি সাধারণ আসন এবং ২০টি উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভোটারদের জন্য সংরক্ষিত। সেখানে সংরক্ষিত আসনগুলোতে শুধুমাত্র উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভোটাররা প্রার্থী হতে পারেন।
তেমনি বাংলাদেশেও সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশের বর্তমান ৩০০ আসনকে ভেঙ্গে ৩৫০টি আসন করতে হবে এবং এর মধ্যে ৫০টি আসন নারী প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। সেই ৫০ আসনে সবাই ভোট দিতে পারলেও প্রার্থী হতে পারবেন শুধু নারী প্রার্থীরা। তাহলে প্রতিযোগীতার মধ্যদিয়ে নারীরা সংসদে জয়ী হয়ে আসবেন। আর সংসদে কোন ৫০ আসন সংরক্ষিত থাকবে তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করে দিবে। যেমন ১৩তম সংসদে যে ৫০ আসন সংরক্ষিত থাকবে সেগুলো পরবর্তী সংসদে আর থাকবে না। এভাবে ধারাবাহিক ভাবে সবগুলো আসনেই পর্যায়ক্রমে সংরক্ষিত আসন হিসেবে নির্বাচন হবে। এই পদ্ধতিটি ভারতের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রয়োগ করা হয়। সেখানে নারী কাউন্সিলর এর জন্য একেক বছর একেক ওয়ার্ড বা আসন সংরক্ষিত থাকে। এর জন্য ইসির ম্যাপ তৈরি করা রয়েছে কোন নির্বাচনে কোন আসন সংরক্ষিত হবে। বাংলাদেশে এই নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা গেলে নারী সংসদ সদস্যদেরকে কেউ আর সংসদের অলঙ্কার বলতে পারবে না। কারন তারাও সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে আসবেন।