জাতীয় সংসদে ডাকসুর সাবেক তিন ভিপির কেউই নেই মন্ত্রিসভায়

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) বলা হয় দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন ডাকসুর নেতারা। দেশ স্বাধীনের পর থেকে প্রায় সবকটি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও পদে অধিষ্ঠিত হয়েও তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ বিনির্মাণে। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডাকসুর সাবেক তিন ভিপি রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহমেদ ও আখতারুজ্জামান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়নি তাদের কারোরই। শুধু এবার নয়, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত বিগত সরকারেও ডাকসুর কোন সাবেক ভিপি মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি।

১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসুর ভিপি ছিলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রাশেদ খান মেনন। একই বছর জিএস ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী মতিয়া চৌধুরী। মতিয়া চৌধূরী জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি মেনন। বাংলাদেশের একজন বামপন্থী ধারার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাশেদ খান মেনন প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ৫ম সংসদ নির্বাচনেও তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী হিসেবে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। এর পর ২০০৮ সাল থেকে টানা তিন দফায় ঢাকা-৮ আসন থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন রাশেদ খান মেনন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন এবং নির্বাচনের পর গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে বরিশাল-২ আসনে (উজিরপুর-বানারীপাড়া) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন মেনন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ৩১ হাজার ১৬২ ভোট। এমপি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এক প্রশ্নের জবাবে নিজেকে ‘হারাধনের একটি ছেলে’ বলে উল্লেখ করেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ‘টেকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। সংগ্রাম করে টিকে থাকাটা বড় ব্যাপার। বিশেষ করে আমরা যারা সাধারণ মানুষের সাথে মিশি, চলি; যাদের অর্থবিত্ত নেই, তাদের এ ধরনের নির্বাচনে বেরিয়ে আসা কঠিন কাজ।’ মানুষ তাঁকে ‘পুরোনোভাবেই গ্রহণ করেছে’ মন্তব্য করে বলেন, ‘আমার বিজয়টা এবার বিস্ময়কর লেগেছে। কারণ, ১৯৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সব নির্বাচনের মধ্যে এবার আমি সর্ববৃহৎ ব্যবধানে জিতেছি।’

মেনন ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বে আসেন। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে বারবার জেলে যেতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এমএ পাস করেছেন জেলখানা থেকে পরীক্ষা দিয়ে। সে সময়ের প্রধান ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কর্মসূচি ঘোষণা করার ফলে ইয়াহিয়ার সামরিক আদালত তাঁকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানসহ জাতীয় রাজনীতির প্রতিটি সংকটে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন।

অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ডাকসুর ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তৎকালিন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮  ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী এবং ২০০৮ সালে ৮ম সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারেও তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের পরবর্তী তিনটি মন্ত্রিসভায় তার আর স্থান হয়নি।

এদিকে ১৯৮২ সালের ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি এবং ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে দুইবারের জিএস আখতারুজ্জামান। আশির দশকে তৎকালীন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে তৎপর ছিলেন তিনি। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়ে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে নেতৃত্ব দেন। ওই সময় এরশাদের মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন এবং কারাবরণ করতে হয়েছিল এ নেতার। পরবর্তীতে ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাংগঠনিক সম্পাদক। এ দল থেকেই সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের টিকিট পেয়ে জয়ী হন আখতারুজ্জামান। ২০১৬ সালে গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-৫ আসন থেকে নৌকার প্রার্থী মেহের আফরোজ চুমকিকে হারিয়ে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাকসুর সাবেক ভিপি ও আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান। তিনিও মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি।

Print Friendly, PDF & Email