এমরান হোসাইন শেখ (বিশেষ প্রতিনিধি,বাংলাট্রিবিউন):
দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর নারী নেতৃত্বে অন্যতম দৃষ্টান্ত বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। দেশের তৃতীয় শীর্ষ পদধারী এই ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনে সরাসরি ভোটে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকার ড. শিরীনকে গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ টানা চতুর্থবারের মতো স্পিকার নির্বাচিত করেছে। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি একবার সংরক্ষিত আসনে এবং তিন বার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার আগে সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী এই নারী নেতৃত্ব।
চতুর্থবারের মতো স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের অনুভূতি, দেশের নারী সমাজের অগ্রগতি এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলেছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকালে নিজের নির্বাচনি এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর সময় সেখানকার নারীদের অবস্থানগত পরিবর্তনের বিষয়টিও উঠে এসেছে তার বক্তব্যে। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, হয়তো আমাদের সংসদ নেতার একটা বিবেচনা ছিল একটু তরুণ-নবীনকে এ পদে আনতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয়— ভারত ও পাকিস্তানে নারী স্পিকার ছিল, কিন্তু বাংলাদেশে তখনও পর্যন্ত এ পদটাতে নারী ছিল না। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, উপনেতারা নারী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব ইচ্ছা ছিল— এ পদে একজন নারীকে আনবেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী যে আস্থা ও প্রত্যাশা নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটার মর্যাদা রক্ষা করতে পারার বিষয়ে আমাকে সব সময় সচেতন থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম নারী এবং টানা চার বার স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে অনুভূতি জানতে চাইলে স্পিকার বলেন, অনেকেই কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বে এ বিষয়টা বিরল। অনেক সংসদ সদস্য সংসদের ফ্লোরেও উদাহরণ দিয়েছেন। এমনিতে নারী স্পিকার তো বিরল। তারপরও পরপর মেয়াদে টানাভাবে থাকার উদাহরণ কম পাওয়া যায়। সেদিক থেকে আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। এত বড় সম্মানের জায়গায় আমি আসতে পেরেছি। এটা থেকে যে বিষয়টা নিয়ে গর্ব করতে পারি, সেটা হচ্ছে সবার আস্থা ও বিশ্বাস আমার ওপর আছে দেখেই আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে। সে জায়গাটা তৈরি করতে সময় লেগেছে। আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করি, এত বড় দায়িত্বে আসতে পেরেছি। দেশকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি।
তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করি, সেখানেও অনেক আলোচনা ছিল। আবার তখন বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ স্পিকারও ছিলাম। বিশ্বে কিন্তু অনেক তরুণ নেতা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সে জন্য তরুণ নারী হিসেবে আমার আসাটা একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সবাই তা গ্রহণ করেছে এবং স্থায়িত্বের দিকে গেছে। যেটা ভালো। যখন আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম সব চ্যালেঞ্জ নিয়েই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। আমার নিজের জবাবদিহির জায়গা থেকে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি মানুষের প্রত্যাশা ও সমালোচনার প্রতি আমার জবাব কী হবে, সেটা নিয়ে সবসময় ভাবতে হয়েছে।
স্পিকার হিসেবে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নারী হিসেবে যে দায়িত্বটা পেয়েছি, সেটা যদি ঠিকভাবে পালন করতে না পারি, তাহলে সব নারীর জন্য নেতিবাচক প্রতিফলন হতে পারে যে— একজন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু উনি পারেননি। এটা সব নারীর জন্য নেতিবাচক হয়ে যেতে পারে। এটা অনেক বড় দায়িত্ব ও ভাবনার ছিল। প্রধানমন্ত্রী যে আস্থা, প্রত্যাশা ও বিশ্বাস নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটার মর্যাদা যেন রক্ষা করতে পারি, সেই বিষয়টা নিয়েও আমাকে সবসময় সচেতন থাকতে হয়েছে। কারণ, আমার কারণে ওনার যে আকাঙ্ক্ষা, যেটা উনি বাস্তবায়ন করেছেন— সেটা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে বিষয়টা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদ উপনেতাসহ মন্ত্রিসভায় কয়েকজন নারী নেতৃত্ব রয়েছেন। দেশের শীর্ষ পদগুলোতে গুটিকয়েক নারী নেতৃত্বের মাধ্যমে সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র ফুটে ওঠে কিনা? এ বিষয়ে শিরীন শারমিন চৌধুরী পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন— আপনি বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বের চিত্র জানেন? আপনি এটা জানেন না। আমরা তো নির্বাচনটা করে আসলাম। নারীরা যে কতটা সচেতন, সেই চিত্র আমি নির্বাচন করতে গিয়ে দেখেছি। আমি তো বলবো, এই নারীদের ভোটেই আমরা জিতে এসেছি। নির্বাচনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখেছি। ভোটকেন্দ্রে তাদের দীর্ঘ লাইন দেখেছি। বাচ্চা কোলে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে দেখেছি। একেক এলাকায় যে পরিমাণ মা-বোনেরা একেকটা পথসভায় উপস্থিত হন, বক্তব্য শোনার জন্য দীর্ঘসময় বসে থাকেন। তীব্র শীত ও গভীর রাতেও তাদের বিকার নেই। তারা
সবাই উপস্থিত। রাজনৈতিক বক্তব্য শুনছেন। তারা কোন প্রার্থীকে এবং কেন ভোট দেবেন, সেটা তারা নিজেই পর্যালোচনা করেন। কোথায় ভোট দেবেন সেটার সিদ্ধান্তও নেন। তিনি বলেন, এই যে নারী শক্তির একটা জাগরণ, এটা কীভাবে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের মেয়াদে তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের এগিয়ে আনার জন্য যত কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা তারই ফসল। কাজেই নারী নেতৃত্ব শুধু সংসদে নয়। নারী নেতৃত্ব শুধু প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা পাঁচ জন মন্ত্রী নয় নারী নেতৃত্ব আজকে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে। আমাদের এবারের ভোটের মন্ত্র ছিল— নারী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত করা। সেটা আমরা করতে পেরেছি বলেই এই নিরঙ্কুশ জয় আমাদের এসেছে। এটাই হলো বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রকৃত চিত্র। নারীরা যেভাবে কথা বলেন, তাদের দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করেন, তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, আপনি শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। নারী নেতৃত্বের অগ্রগতি প্রশ্নে দলীয় মনোনয়ন ছাড়াই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হওয়া কয়েকজন নারীর উদাহরণ দিয়ে স্পিকার বলেন, অনেক সময় হয়তো পথ কেউ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু ওইপথে নিজেকেই হাঁটতে হয়। কেউ কাউকে জায়গা করে দেয় না। জায়গা করে নিতে হয়। এবার আমরা সংসদে দেখতে পেয়েছি একাধিক নারী। যারা দলের মনোনয়ন না পেয়েও নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসেছেন। তারা সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়ে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার পাশাপাশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলেই ভোটারা তাকে বেঁছে নিয়েছে। আমি মনে করি, এটা অন্য নারীদের জন্য অনুকরণীয়।
নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে জাতীয় সংসদের স্পিকার বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েরাও এখন শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে, উচ্চশিক্ষাও গ্রহণ করছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সক্ষমতা তৈরিতে এগিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছেন, সে কারণে নারীরা আজ তাদের সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।