সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার সংসদ ছাড়া সম্ভব না : আইনবিদদের অভিমত

 

রফিকুল ইসলাম সবুজ :
ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব দাবি উঠেছে তার অন্যতম হচ্ছে সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি জাতীয় সংসদে ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালুর বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় সংস্কারের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে আইনবিদরা বলছেন এই দুই সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ দিলেও সংবিধান এবং নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার জাতীয় সংসদ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই বর্তমান অন্তবর্তীকালিন সরকার এবিষয়ের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারবে না, এটা করতে হবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে। তবে উচ্চ আদালতে রুলের নিষ্পত্তির সময় রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে অর্থাৎ সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুন:স্থাপিত হবে।

সরকার সংস্কার শেষ করেই নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছে। সরকারের উপদেষ্টা এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলম সম্প্রতি বলেছেন ‘এক দফা ঘোষণার দিনই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে’ এবং ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এই সরকারই বাস্তবায়ন করবে।’ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। একারনে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে যে সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের এখতিয়ার বর্তমান সরকারের রয়েছে কি-না। কারণ সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।’ ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) আইন, ২০১৮ প্রবর্তনকালে বিদ্যমান সংসদের অব্যবহিত পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে শুরু করিয়া পঁচিশ বৎসরকাল অতিবাহিত হইবার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভাংগিয়া না যাওয়া পর্যন্ত পঞ্চাশটি আসন কেবল মহিলা-সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে এবং তাঁহারা আইনানুযায়ী পূর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হইবেন’। আইনবিদ ও রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, ভোটের আনুপাতিক পদ্ধতিতে সংসদের আসনবন্ঠনসহ নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের যে আলোচনা চলছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তুু দেশে বর্তমানে সংসদ কার্যকর না থাকায় সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হবে না। তাই বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই আগামী নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আর সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ দেবে তা বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার। ফলে সংস্কারের পরে নির্বাচনের যে কথা বলা হচ্ছে তার যৌক্তিকতা এক্ষেত্রে তেমন একটা নেই।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও বলছে সংবিধান সংশোধন করা কিংবা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের এখতিয়ার একমাত্র জাতীয় সংসদের। এমনকি উভয় দলই মনে করে সংবিধান সংশোধন হবে নাকি নতুন করে লেখা হবে- সেটিও শুধুমাত্র সংসদের এখতিয়ার। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ প্রণয়ন করবে তার ভিত্তিতে নতুন সংসদে সংবিধান সংশোধন করা হবে- এমন একটি ঐকমত্য নির্বাচনের আগে হতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন সংবিধান সংশোধন করা সংসদের কাজ। সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধন করলে কতগুলো জটিলতার সৃষ্টি হবে। সংবিধান বিতর্ক জাতিকে সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিতর্ক হলে অনেক ষড়যন্ত্র হবে এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের নির্বাচন পদ্ধতির আমুল পরিবর্তন প্রয়োজন। কারণ গণতান্ত্রিক নির্বাচন হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে একতরফা ভাবে হওয়ায় সেগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছিল না। তিনি বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি হবে কি না সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আবার দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে কি না তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে এটা করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও কিছু পরিবর্তন আনা হবে। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হবে না কি নির্দলীয় হবে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার বর্তমানে মেয়র ও চেয়ারম্যান সর্বস্ব। এটাকে সংসদীয় পদ্ধতির মতো করা যায় কি না সে বিষয়েও চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। স্থানীয় এবং জাতীয় সব নির্বাচনের বিষয়ে সুপারিশ থাকবে কমিশনের প্রতিবেদনে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন,  পঞ্চদশ সংশোধনী ছিল অসাংবিধানিক। এর মাধ্যমে ভোটাধিকার হরণ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করা হয়েছে। তারা আশা করছেন উচ্চ আদালতে এ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসবে, এটা একটা ভিত তৈরি করবে। যার ভিত্তিতে বর্তমান সরকার নির্বাচনকালীন সরকার বিভিন্ন সংস্কার করতে পারবে ।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছি সেটা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা জানানো। তবে আমাদের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করতে হবে। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের দিকে যদি তাকাই, তাহলে এই প্রস্তাবনাগুলো এই সরকারের জায়গা থেকে সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ আছে কি না সেটা ভেবে দেখা দরকার।  সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের কথা তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই অনুচ্ছেদে আপনি সবকিছু করতে পারবেন শুধু সংবিধান সংশোধন ছাড়া। এখন সংসদ নেই, গণভোট নেই- তাই এই প্রশ্নগুলো এখানে যৌক্তিক ও আইনগতভাবে আসবে। এই অনুচ্ছেদে সংসদ ভেঙে গেলে বা সংসদ অধিবেশনে না থাকলে রাষ্ট্রপতি কী কী বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেন, সেই বিষয়ে সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান এমন কোনো অধ্যাদেশ জারি করবেন না যা এই সংবিধানের অধীন সংসদের আইন-দ্বারা আইনসঙ্গতভাবে করা যায় না;  যাতে এই সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তিত বা রহিত হয়ে যায়; অথবা যার দ্বারা পূর্বে প্রণীত কোনো অধ্যাদেশের যে কোনো বিধানকে অব্যাহতভাবে বলবৎ করা যায়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্র্বতী সরকার সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার নিয়েই শপথ নিয়েছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, কোনো সরকারের সাংবিধানিক অধিকার নেই সংবিধানকে সংশোধন করার। এটা পারে একমাত্র সংসদ। তিনি বলেন, একটা ধারণা থেকে প্রচার করা হচ্ছে যে অন্তর্র্বতী সরকার বোধহয় সংবিধান সংশোধন করবে। আসলে কোনো সরকারের সাংবিধানিক অধিকার নেই সংবিধানকে সংশোধন করার। আগামীতে যে সংসদ গঠিত হবে সেই সংসদ সংবিধান সংশোধন করবে। তিনি বলেন, তাদের সামনে জনগণের যে প্রত্যাশা, যে দাবি, যে আকাঙ্ক্ষা সেটাই এখন বিভিন্নভাবে কমিশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা একটি সুপারিশ দেবেন। আগামীতে যে সংসদ গঠিত হবে  তাদের সামনে একটি নাগরিক চার্টার হিসেবে থাকবে (সংবিধানের খসড়াটি)। তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করবেন। তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার মাধ্যমে যে খসড়া বা সাজেশন দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে তারা আরও নতুন নতুন অনেক কিছু আনতে পারবেন।

সুত্র : দৈনিক সময়ের আলো।
##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *