নিজস্ব প্রতিবেদক:
কমিশনের বিনিময়ে বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমকে কাজ পাইয়ে দেয়াসহ দুর্নীতির মাধ্যমে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে দুদকের মামলার চার্জশিট আদালতে গৃহীত হওয়ায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এছাড়া কাজ সম্পন্ন করার আগেই জি কে শামীমকে অবৈধ ভাবে অগ্রিম ১০ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মোহাম্মদ ফজলুল হককে বেতন গ্রেড কমানোর শাস্তি দিয়েছে। তবে এই দুই প্রকৌশলীকে শাস্তি দেওয়া হলেও এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছেন জি কের সহযোগি হিসেবে পরিচিত গণপূর্তের অন্তত ১৫ প্রকৌশলী। সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জি কে শামীমকে ঘুষের বিনিময়ে অবৈধ ভাবে কাজ পাইয়ে দেওয়া এবং কাজ করার আগেই অগ্রিম বিল পরিশোধের সঙ্গে একাধিক প্রকৌশলী জড়িত থাকলেও তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি।
এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়সারা তদন্ত করে সবাইকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিলেও পটপরিবর্তনের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। কিছু দিন দুদক এর পরিচালক মো. আব্দুল মাজেদকে দলনেতা করে ৪ সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে। এই অনুসন্ধান কমিটি গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল হকহর বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান প্রকৌশলীর অনিয়ম দূর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আলোচিত ঠিকাদার জিকে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর গণপূর্তের কিছু প্রকৌশলীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে। জি কে সিন্ডিকেটের সদস্যরা মিলে ঠিকাদারি কাজের পাশাপাশি বদলি বাণিজ্য, পদোন্নতি বাণিজ্য, পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেয়া, গোপন টেন্ডার অনুমোদনসহ সব ধরনের কাজ করে আসছিলেন। পঙ্গু হাসপাতালের আধুনিক ভবন নির্মাণ, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ভবন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, নিউরো সাইন্স, বিজ্ঞান জাদুঘর, র্যাব সদরদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প জি কে শামীমের জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (জি কে বিল্ডার্স) করেছে। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে ইজিপি এড়িয়ে ওটিএম’র মাধ্যমে প্রকল্পের টেন্ডার শুরু করে প্রকৌশলী সিন্ডিকেট। ২০১৯ সালে জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার সময় জিকেবি অ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে সচিবালয়, র্যাব হেড কোয়ার্টার, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালসহ বড় বড় ১৭টি প্রকল্পের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারির কাজ করছিল। অভিযোগ রয়েছে মেসার্স জি কে বিল্ডার্স তার প্রতিষ্ঠানের বাগিয়ে নেওয়া বেশিরভাগ প্রকল্পেরই ব্যয় ও সময় বাড়তো অবিশ্বাস্যভাবে। আর একাজে তাকে সহায়তা করতো গণপূর্তেরই সংস্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। ব্যয় বাড়লে প্রকৌশলীদের কমিশনও বাড়তো।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর একনেক বৈঠকে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আওতায় ১৪১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ২০তলা বিশিষ্ট রাজস্ব বোর্ড ভবন নির্মাণ করার কথা ছিল। পরে ভবন ১২ তলা করার সিদ্ধান্ত হলেও জি কে বিল্ডার্স প্রকল্পে ব্যয় বাড়িয়ে করে ৪৯৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ কমলেও ব্যয় বেড়ে যায় ৩৫৪ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া ‘জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ায় জি কে বিল্ডার্স। প্রকল্পটি শুরুর সময় ৩৩৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও শেষ হয় ৫০০ কোটি টাকায়।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ক্যাসিনোকাণ্ডে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর ক্যাসিনো ও অন্যান্য অবৈধ মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এতে নাম আসে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দের। ২০২০ সালের ৫ আগস্ট দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ সংস্থাটির কর্মকর্তা নেয়ামুল আহসান গাজী বাদী হয়ে উৎপল কুমার ও তার স্ত্রী গোপা দের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। পরে তাকে সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৫৭ নং আইন) এর ৩৯ (২) অনুযায়ী ১০-১০-২০২৩ তারিখ থেকে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীমের সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে ৭ কোটি ৮০ টাকার সম্পদ অর্জন করার কথা বলা হয় মামলায়। তার নামে মামলা হলেও জিকে শামীমের সহযোগীরা দুদক এর মামলা থেকে রেহাই পেয়ে গেছেন কিভাবে তানিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা রয়েছে।
অন্যদিকে কাজ সম্পন্ন করার আগেই আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমকে অবৈধ ভাবে অগ্রিম ১০ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করার ঘটনায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী, শেরেবাংলা নগর-১ এর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে রাজশাহীতে চলতি দায়িত্বে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত) মোহাম্মদ ফজলুল হককে বেতন গ্রেড কমানোর শাস্তি দিয়ে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
সংস্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর র্যাব সদর দফতরের কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয় ২০১৯ সালের জুনে। তখন টেন্ডার নিষ্পত্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (প্রকল্প ও বিশেষ প্রকল্প -পিএনএসপি) ড. মঈনুল ইসলাম। প্রচলিত বিধি অনুযায়ী, প্রকল্পের দরপত্র গণপূর্ত ঢাকা সার্কেল-৩ থেকে আহ্বান ও তৎকালীন ঢাকা গণপূর্ত জোন থেকে মূল্যায়ন করার কথা। র্যাব সদর দফতরের কাজের টেন্ডার গণপূর্ত ঢাকা সার্কেল-৩-এর অধীনে। কিন্তু নিয়মনীতি না মেনে গণপূর্ত অধিদফতরের (সদর দফতর) থেকে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সকে র্যাব সদর দফতর নির্মাণের কাজ পাইয়ে দেওয়ার ঘটনায় ভূমিকা রাখেন তিনি। কিন্তুু এ কাজের সঙ্গে জড়িতরা ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছেন। চাকরি
জীবনের শুরু থেকেই মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আছে। ১৫তম ব্যাচের সহকারী প্রকৌশলীরা ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর যোগদান করলেও মঈনুল ৯ মাস পর ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাকরিতে অনুপস্থিত ছিলেন। ৯ বছর ৮ মাস ২২ দিন অনুপস্থিত থাকায় মঈনুলকে চাকরি থেকে চূড়ান্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য মন্ত্রণালয়ে আপিলের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান তিনি।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে জি কে শামীম ছাড়াও সাজিন এন্টার প্রাইজ, নভেল্টি এন্টারপ্রাইজ ও বাবর এসোসিয়েট নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে অলিখিত পার্টনারশীপ এর মাধ্যমে বিপুল পরিমান কাজ পাইয়ে দিয়ে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে দুদক এর কাছে। এছাড়া গোল্ডেন মনিরের সাথে যোগসাজসেও আর্থিক সুবিধা গ্রহনের অভিযোগ রয়েছে। তিন দফা পদোন্নতি পেয়ে মোসলেহ উদ্দীনকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হতে সহায়তা করে কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম।
এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান প্রকৌশলী জি কে সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে পরিচিত বলে তখন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়ে ছিল। যাদের বিরুদ্ধে দুদক নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে।
##