নিজস্ব প্রদিবেদক
ফ্যাসিবাদের ভূত এখনো রয়ে গেছে গণপূর্ত অধিদপ্তরে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফ্যাসিস্ট ঠিকাদার সিন্ডিকেটের অধিকাংশই পলাতক রয়েছেন। অথচ তাদের দোসর ঢাকা নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে চলতি অর্থবছরের এপিপির বরাদ্দের টাকা দিয়ে নতুন কাজ না করে ফ্যাসিস্ট ঠিকাদারদের বকেয়া বিল পরিশোধ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে বরাদ্দ পাওয়া ২৭ কোটি টাকার বেশির ভাগই তিনি বকেয়া বিল দিয়েছেন। শুধুমাত্র প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও কয়েকজন উপদেষ্টার বাসভবন সংস্কার কাজ ছাড়া নতুন কোন কাজের বিল দেননি তিনি। ফ্যাসিবাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদীয় আসনের প্রতিনিধি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকারের ক্যাশিয়ারখ্যাত নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ ৫ আগষ্টের পর ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩ থেকে প্রাইজ পোস্টিং হিসেবে নগর গণপূর্ত বিভাগে পদায়ন নেন। এক্ষেত্রে সদ্য অবসরে যাওয়া গণপূর্ত সচিব হামিদুর রহমান খান প্রাইজ পোস্টিং এর জন্য বড় ভূমিকা পালন করেন। পোস্টিং পাওয়ার পরই তিনি ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর দোসর ঠিকাদার সিন্ডিকেটের সদস্যদের বকেয়া বিল দিয়ে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন।
একাধিক ঠিকাদার ও কর্মকর্তা জানান, যে সব বকেয়া বিল দেওয়া হচ্ছে এগুলোর অধিকাংশই ভুয়া কাজের বিল। বেশির ভাগ কাজেরই কোন অস্তিত্বি নেই। যাদেরকে বিল দেওয়া হচ্ছে তাদের অনেকেই ছাত্র হত্যা মামলার আসামী। নির্বাহী প্রকৌশলীর ডিলিং এ্যাসিস্ট্যান্ট এর মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তিতে ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন নিয়ে বিল দেওয়া হচ্ছে। কারণ অধিকাংশ কাজই ভুয়া হওয়ায় ঠিকাদার বেশি কমিশন দিয়ে বিল নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে গোপালগঞ্জে বাড়ি নগর গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির সাধারন সম্পাদক শেখ দ্বীন ইসলামের এস এ এন্টারপ্রাইজকে বিল না দিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে আওয়ামী সিন্ডিকেটের ঠিকাদারদের বিল দেওয়া হচ্ছে না। তবে বাকি সব ঠিকাদারের বকেয়া বিল ও নিরাপত্তা জামানতও ফেরত দেওয়া হচ্ছে কমিশনের বিনিময়ে।
সংস্লিষ্টরা জানান, নগর গণপূর্ত বিভাগে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) এরগত অর্থ বছরের বরাদ্দ ছিল ৪৭ কোটি টাকা। কিন্তুু এই টাকার কাজ করার পরও অতিরিক্ত আরও ২২ কোটি টাকার কাজ দেখানো হয়। মূলত গোপালগঞ্জ ও শেখ পরিবার এবং আওয়ামী লীগের ঠিকাদার সিন্ডিকেটকে ভুয়া ও অস্তিত্বীন কাজের নামে এই বিশাল টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর আগের অর্থ বছরেও বরাদ্দের চেয়ে ৭ কোটি টাকা বেশি ব্যয় দেখানো হয় বিভিন্ন কাজের নামে। একারনে দুই অর্থ বছরে এই বিভাগে ২৯ কোটি টাকা বকেয়া বিল হয়েছে। গত অর্থ বছরে একই কাজকে দুই বার দেখিয়ে বিল দেওয়ার বিষয়টি প্রমানিত হওয়ায় একজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। এছাড়া প্রধান বিচারপতির বাস ভবন মেরামতের নামেও ২০ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়। এসব কাজের বেশির ভাগই ভুয়া হওয়ায় বর্তমান নির্বাহী আজাদ প্রকৌশলী চলতি অর্থ বছরের বরাদ্দ থেকে বকেয়া বিল দিতে বেশি আগ্রহী হয়েছেন। ইতিমধ্যে ৮০ শতাংশ বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ এপিপির জন্য বরাদ্দ নেওয়া নতুন কাজ করা হচ্ছে না।
একাধিক ঠিকাদার অভিযোগ করেন নতুন কাজ করা হলে ফ্যাসিস্ট ঠিকাদারদের বেশির ভাগই পলাতক থাকায় তারা কাজ করার সুযোগ পাবেন না একারনে নির্বাহী প্রকৌশলী নতুন কাজ না করে ভুয়া কাজের বকেয়া বিল দিচ্ছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী দীর্ঘ দিন গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ে দায়িত্ব পালন করায় মন্ত্রী এবং সচিব এর সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিশেষ করে সাবেক সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার ও তার ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত মন্ত্রনালয়ের সাবেক সিনিয়র সহকারি প্রধান বর্তমানে উপসচিব মুমিতুর রহমানের অনিয়ম দূর্নীতির অন্যতম সহযোগী ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ। বিসিএস ২৪তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা তার ব্যাচে মেধাতালিকায় প্রথম হওয়ায় আগামী প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একারনে তিনি এখনই থেকেই নানা অনিয়ম দূর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করছেন যাতে প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার সময় কাজে লাগাতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২১ অক্টোবর ২০২৪ প্রধান প্রকৌশলীর এক প্রজ্ঞাপনে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩ হতে তাকে নগর গণপূর্ত বিভাগ ঢাকায় পদায়ন করেন প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) পালন করা মোঃ শফিকুল ইসলাম। এর আগে কখনও রুটিন দায়িত্ব থাকা প্রধান প্রকৌশলী নির্বাহী প্রকৌশলী বা কোন প্রকৌশলীর পদায়ন প্রজ্ঞাপন জার্রি করতে দেখা যায় নি। নগর গণপূর্ত বিভাগের আওতাধীন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা দেখাশুনার দায়িত্ব যদি ফ্যাসিবাদের অন্যতম দোসর আবুল কালাম আজাদ থাকায় কর্মকর্তাদের ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এদিকে নগর গণপূর্ত বিভাগ, ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগ এনে তার অপসারণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন হয়েছে। এতে বক্তারা বলেন, আবুল কালাম আজাদ ফ্যাসিবাদের অন্যতম দোসর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতনের ঘনিষ্টজন। গত অর্থ বছরে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩ এ থাকাকালীন সময় কাউন্সিলর রতনকে পাঁচ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেন। ছাত্র ও জনতার আন্দোলন দমাতে রতনকে অর্থ দেন আজাদ। তারা বলেন, আবুল কালাম আজাদ নগর গণপূর্ত বিভাগে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রধান প্রকৌশলীর প্রজ্ঞাপন অমান্য করে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে এলটিএমের পরিবর্তে ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করেন।