ঘুষ, দুর্নীতিতে রেকর্ড গড়েছেন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সাব-রেজিষ্ট্রার বোরহান উদ্দিন

নিজস্ব প্রতিনিধি:
মুজিন নগর সরকারের কথিত কর্মচারী পারিচয়দানকারী ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সাব রেজিস্ট্রার বোরহান উদ্দিনের ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও দালাল সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্মে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সর্বসাধারণ। সকাল ১০টা থেকে অফিসের কার্যক্রম চলার কথা থাকলেও দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রার বোরহান উদ্দিন সরকারী এ নিয়ম না মেনে নিজ নিয়মে অফিস করেন বিকেল ৪টার পর থেকে এবং তা চলে মধ্য রাত পর্যন্ত।

সাব রেজিস্ট্রার বিকেল ৪টার পর অফিসে বসে দু’একটি দলিল রেজিস্ট্রি করে নিজ কক্ষে বিশ্রামে যান। বিকেল ৫টার পর লেট ফি অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা নিয়ে দলিল লেখক সিন্ডিকেটের সহায়তায় রেজিস্ট্রি কার্যক্রম করে থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে থাকেন তিনি। সরকারি নীতিমালায় হেবা দলিলে ৭৮০ টাকা এবং কবলা দলিলে ৩৮০ টাকা ফিস সরকার নির্ধারিত থাকলেও, দৌলতপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে নির্ধারিত ফিস বাদেও হেবা দলিলের জন্য ৩ হাজার ২২০ টাকা এবং কবলা দলিলের জন্য ৩ হাজার ১২০ টাকা আদায় করা হয়ে থাকে। এছাড়াও সরকারি ভাবে মৌজা মূল্যের বেশি মূল্যে শতকরা ২ টাকা, জমির শ্রেণী না থাকলে শতকরা ২ টাকা, বন্টন নামা দলিলে শতকরা ১ টাকা সহ শ্রেণীর বাড়ী হলে ১০ হাজার টাকা, এক দলিলে দুটি মৌজা হলে ২০ হাজার টাকা, ওয়ারিশ সূত্রের দলিলে ২০ হাজার টাকা, জাতীয় পরিচয় পত্রে নামের সমস্যা থাকলে ৭ হাজার টাকা নির্ধারণ করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে থাকেন সাব-রেজিস্ট্রার বোরহান উদ্দিন সরকার। এছড়াও সাব-রেজিস্ট্রারের ব্যক্তিগত কক্ষে (খাস কামরা) দলিল করলে দলিলপ্রতি সর্বনিম্ন অতিরিক্ত ৯ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় তাকে। যা মোট দলিলের শতকরা ৮০ ভাগ দলিলই দলিল লেখকদের জিম্মি করে রেজিস্ট্রি করানো হয়ে থাকে খাস কামরায়। এছাড়াও পে-অর্ডারের নামে চলে আরেক দফা হরিলুট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, হোগলবাড়ীয়া মৌজায় আমার একটি ৫ কোটি টাকা মূল্যের দলিলে সাব-রেজিস্ট্রার ১৫ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত নিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করেছে। অপর এক ভুক্তভোগী বলেন, আমার ৩৮ হাজার টাকা মূল্যের একটি দলিল রেজিস্ট্রি করতে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আর এমন অভিযোগ নিত্যদিনের এবং সব সেবা গ্রহীতারই । এর আগেও বহুবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন কথিত মুজিন নগর সরকারের কর্মচারী পারিচয়দানকারী ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সাব রেজিস্ট্রার বোরহান উদ্দিন।

সাব-রেজিস্ট্রার বোরহানের স্ত্রীর নামে ৮ ফ্ল্যাটঁ:
২০২৩ সালে ফেনী সদরের সাব-রেজিস্ট্রার থাকাকালীন সময়ে সাব-রেজিস্ট্রার বোরহান উদ্দিন সরকারের স্ত্রীর নামে এক ভবনেই একাধিক ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া যায়। রাজধানীর শ্যামলী স্কয়ারের বিপরীতে শ্যামলীবাগের ৩ নম্বর রোডের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি বহুতল আলিশান বাড়ি। ‘লায়লা বাছেত ক্যাসল’ নামের বাড়িটির নম্বর ২৭/ক। বাড়িটিতে আটটি ফ্ল্যাট আছে বোরহান উদ্দিন সরকার সাব-রেজিস্ট্রারের স্ত্রীর নামে। ফ্ল্যাটগুলো হলো-১/এ, ২/এ, বি, সি, ৩/এ, বি, সি, ৪/বি। আশপাশের লোকজন জানেন, এসব ফ্ল্যাটের মালিক সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার স্ত্রী বড় ব্যবসায়ী। সেই অর্থেই একের পর এক ফ্ল্যাট কিনছেন। এলাকায় কেউ ফ্ল্যাট বেচলেই খোঁজ পড়ে এ দম্পতির। দৃশ্যত কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকলেও এসব ফ্ল্যাটের মালিক সাব-রেজিস্ট্রার বোরহান উদ্দিন সরকারের স্ত্রী নাসরিন হক। অভিযোগ আছে, বোরহান যেখানেই যান, সেখানেই দুর্নীতি-অনিয়ম করেন। বারবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ‘অদৃশ্য শক্তি’র জোরে রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এভাবেই ধরাকে সরা জ্ঞান করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। স্ত্রীর নামে শ্যামলীবাগের ওই বাড়িতে থাকা ফ্ল্যাটের নামজারিসহ সব কাগজপত্র রয়েছে । সরেজমিন গিয়েও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরে জমিসহ নামে-বেনামে এই দম্পতির বিপুল সম্পদ আছে বলে জানিয়েছেন তাদের ঘনিষ্ঠরা। অভিযোগ আছে, ময়মনসিংহের ভালুকায় থাকাকালীন বনের জমি দলিল করে দিয়ে নেওয়া টাকায় এসব ফ্ল্যাট কিনেছেন তার স্ত্রীর নামে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চাকরির শুরু থেকেই বেপরোয়া ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার বোরহান। তোয়াক্কা না করে দুর্নীতি আর অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন। ২০১৮ সালে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে থাকাকালে সপ্তাহে দুদিন মঙ্গল ও বুধবার দলিল সম্পাদনের কাজ করতেন। দলিলভেদে ঘুষ নিতেন ৩-৭ হাজার টাকা। অতিরিক্ত টাকা না পেলে কাজেই হাত দিতেন না। তা ছাড়া সরকারি নিয়মের বাইরে গিয়ে টাকার বিনিময়ে কাগজপত্র ছাড়াই দলিল সম্পাদন করতেন। এরপর ২০১৯ সালে বোরহান যান ময়মনসিংহের ভালুকায়। সেখানে তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ স্থানীয় দলিল লেখকরা তার প্রত্যাহার দাবিতে কলমবিরতি কর্মসূচিও পালন করেন। তার বিরুদ্ধে দলিল লেখকদের সঙ্গে অসদাচরণ, অতিরিক্ত টাকা আদায়, সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, সময়মতো অফিসে না আসা, নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা দলিল রেখে সময়ের আগেই অফিস ত্যাগ করা, মনমতো ছুটি কাটানোসহ নানা অভিযোগ ছিল। ২০২০ সালে করোনার দোহাই দিয়ে টানা প্রায় ৩ মাস অফিস করেননি বোরহান।
পরে তিনি ভালুকা থেকে যান হালুয়াঘাটে। ২০২৩ সালের ১লা অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের এক চিঠিতে তাকে হালুয়াঘাট থেকে প্রত্যাহার করে ফেনী সদরে পাঠানো হয়। অভিযোগ আছে, সেখানেও বেপরোয়া দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন বোরহান উদ্দিন। আর এখন দৌলতপুরে চালাচ্ছেন সীমাহীন দুর্নীতির স্টিমরোলার।

##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *